চীন থেকে বাংলাদেশের আগে বড় “খয়রাতি” নিয়েছিল ভারত।

করোনায় টিউশন ফি নিয়ে চিঁড়াচ্যাপটা অবস্থায় রয়েছেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অভিভাবকরা। গত জুন মাসে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের অটো প্রমোশন দিয়ে টিউশন ফির জন্য চাপ দিচ্ছে স্কুলগুলো। এমনকি বেতন পরিশোধ না করলে নতুন ক্লাসে নাম এন্ট্রি করা হচ্ছে না। আবার যেসব স্কুলে অনলাইন ক্লাস চালু হয়েছে সেখানেও শিক্ষার্থীদের অংশ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে অনেক অভিভাবকের সামর্থ্য না থাকলেও অনেকটা বাধ্য হয়ে করোনার মধ্যে পূর্ণ বেতন পরিশোধ করছেন তাঁরা।

করোনা পরিস্থিতিতে অভিভাবকরা একাধিকবার টিউশন ফি কমানোর দাবি জানালেও তাতে সাড়া নেই অধিকাংশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের। এদিকে ফি মওকুফের দাবি তোলায় বিভিন্ন স্কুলের বিরুদ্ধে অভিভাবকদের হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো স্কুল অনলাইন ক্লাস শুরু করলেও অনেক শিক্ষার্থীকে লিংক দিচ্ছে না। টিউশন ফি না দিলে রেজাল্ট প্রকাশ না করাসহ বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। ই-মেইল পাঠিয়ে সন্তানকে ছাড়পত্র দেওয়া এবং মানববন্ধন করায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দিচ্ছে। এসব ঘটনায় অভিভাবকদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে।

অভিভাবকরা বলছেন, অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলই বছরে কোটি কোটি টাকা লাভ করে। বছরে ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকা লাভ করছে এমন স্কুলও রয়েছে। অথচ এই বিশ্ব মহামারির সময়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দিচ্ছে না এসব স্কুল। আর এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও কোনো ভূমিকা পালন করছে না। তাহলে অভিভাবকরা কোথায় যাবেন?

উত্তরার বাসিন্দা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা নুরুল চৌধুরীর তিন সন্তান পড়ে ভিন্ন দুটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। তাঁর মতে, স্কুলগুলো টিউশন ফি নিয়ে অনৈতিক আচরণ করছে। তিনি বলেন, অনেক স্কুল শিক্ষকদের বেতন কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি পুরোই নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে অভিভাবকদের অনেকে চাকরি হারিয়েছেন, বাকিদের বেতন কমে গেছে। এই অবস্থায় স্কুলগুলোর বিবেকহীন আচরণে দিশাহারা অভিভাবকরা।   

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাস্টারমাইন্ড স্কুল গত এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ টিউশন ফি কমিয়েছে। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, ব্রিটিশ স্ট্যান্ডার্ড স্কুলসহ হাতে গোনা কয়েকটি স্কুলও টিউশন ফি কমিয়েছে বলে জানা গেছে। তবে অভিভাবকরা শুধু তিন মাস নয়, পুরো করোনার সময়েই বেতন কমানোর দাবি জানিয়েছেন।

গত ২৩ জুন মানববন্ধন করেছেন উত্তরার দিল্লি পাবলিক স্কুলের (ডিপিএস) অভিভাবকরা। তাঁরা বলেন, সীমিত আকারে অনলাইনে ক্লাস চলছে। এর খরচ তেমন একটা নেই। কেননা শিক্ষকরা বাসায় বসে ক্লাস নিচ্ছেন। আর শিক্ষার্থীরা বাসায় থেকে ক্লাস করছে। তাই তাঁরা ৫০ শতাংশ টিউশন ফি দিতে আগ্রহী। এ ছাড়া যেসব অভিভাবকের আর্থিক সংকট চলছে, শুধু তাঁদের মওকুফের দাবি করছেন তাঁরা। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ অমানবিক আচরণ করছে। ই-মেইলে অভিভাবকদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে, বেতন পরিশোধ না করলে ফল প্রকাশ করা হবে না। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের লিংক দেওয়া হচ্ছে না।

এ ছাড়া আরেকটি স্কুল তিন মাসের জন্য ২০ শতাংশ বেতন কমালেও দুই দফায় মানববন্ধন করেছেন অভিভাবকরা। গত ২৯ জুন স্কুল কর্তৃপক্ষের নোটিশে বলা হয়, ‘সম্প্রতি কিছু বিবেকহীন সুবিধাবাদী অভিভাবক নামধারী ব্যক্তি অনৈতিক দৃষ্টিকটু কার্যকলাপ শুরু করেছেন। স্কুলের বেতন দিতে ইচ্ছুক অভিভাবকদের বাধাগ্রস্ত করেছেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। এতে যাঁরা লিপ্ত, স্কুলের সিসিটিভি ফুটেজে তাঁদের ছবি আছে। স্কুল তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার রাখে। স্কুলের প্রতি যে অভিভাবকরা অসন্তুষ্টি পোষণ করেন, তাঁদের প্রতি বিশেষ অনুরোধ রইল, আপনার মনের মতো স্কুল বেছে নিন।’

জানা যায়, দেশে তিন ধরনের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রয়েছে। প্রথম শ্রেণির স্কুলগুলোর মাসিক বেতন ৩০ হাজার টাকার ওপরে। এতে উচ্চবিত্তের সন্তানরা পড়ালেখা করে। দ্বিতীয় শ্রেণির স্কুলগুলোর বেতন ১২ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে, যেগুলোতে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্তের সন্তানরা পড়ালেখা করে। এসব স্কুলের মধ্যে রয়েছে স্কলাসটিকা, সানিডেল, সানবিম, ম্যাপল লিফ, মাস্টারমাইন্ড ইত্যাদি। এর পরের ধাপের স্কুলগুলোর বেতন পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। তবে বেশির ভাগ স্কুলই বেতন না কমানোর ব্যাপারে এখন পর্যন্ত অনড় অবস্থানে রয়েছে। এমনকি ম্যাপল লিফসহ আরো কয়েকটি স্কুল অনলাইন ক্লাস না নিলেও পূর্ণ বেতন দিতে অভিভাবকদের বাধ্য করেছে।

স্কলাসটিকা স্কুলের প্যারেন্টস ফোরামের সভাপতি সৈয়দ মাসুদ রানা বলেন, ‘আমরা প্লে থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ৭৫ শতাংশ এবং তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ বেতন কমাতে বলেছি। আমরা শুধু মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত নয়, পুরো করোনার সময়েই এই বেতন কমানোর কথা বলেছি। স্কুল কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে আলোচনা করলেও এখনো তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি।’

বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও গ্রিন জেমস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ জি এম নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘করোনার মধ্যে উভয় পক্ষকেই কিছুটা ছাড় দিতে হবে। যেহেতু সরাসরি ক্লাস হচ্ছে না, তাই স্কুলগুলোর খরচ কমেছে। এ ক্ষেত্রে তারা কিছুটা কম নিতে পারে। যারা একেবারেই অনলাইন ক্লাস করেনি, তাদের জন্য তো টিউশন ফি কম নেওয়া আরো সহজ। আর যেসব অভিভাবকের পক্ষে সম্ভব তাঁদের টিউশন ফি পরিশোধ করা উচিত। তবে কোনোভাবেই টিউশন ফির প্রভাব যেন শিক্ষার্থীদের ওপর না পড়ে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখা উচিত।’ 

গত সোমবার এক ভার্চুয়াল আলোচনায় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও অনেক প্রতিষ্ঠান টিউশন ফি দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। একেবারে টিউশন ফি না দিলে প্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষকদের বেতন দিতে পারবে না। তাই দুই পক্ষকেই কিছুটা ছাড় দিয়ে মানবিক হতে হবে।’

সম্প্রতি ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে এক আদেশে টিউশন ফি আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করার জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের বলা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে বকেয়াসহ মাসিক বেতন আদায়ের অনুরোধ জানানো হয় আদেশে। কিন্তু এই আদেশের বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না সে বিষয়ে তাদের কোনো তদারকি নেই।