স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা। একেকটি ইউনিয়নে গড়ে তিন-চারজন করে নৌকা প্রতীক চাইছেন। যাঁরা নৌকা পাচ্ছেন না, তাঁরা সংসদ সদস্যবিরোধী হয়ে উঠছেন; যদিও ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে সংসদ সদস্যের আনুষ্ঠানিক কোনো মত দেওয়ার সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতিতে তৃণমূলে দলীয় কোন্দল সামাল দিতে কিছু ইউনিয়নে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখার কথা ভাবছে আওয়ামী লীগ। দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কেউ কেউ চাইছেন, ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার থেকে সরে আসুক আওয়ামী লীগ।
বিষয়টি গত ১৬ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভায় দলটির সভাপতি শেখ হাসিনাকেও জানিয়েছেন একাধিক নেতা। আওয়ামী লীগ সভাপতি নিজেও তাঁর এলাকায় এমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। ফলে যেসব ইউনিয়নে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি জোটের শক্ত প্রার্থী নেই, সেখানে আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা কালের কণ্ঠকে এমনটা জানিয়েছেন।
ওই কেন্দ্রীয় নেতাদের মতে, ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন নিয়ে একদিকে দলীয় কোন্দল বাড়ছে, অন্যদিকে এ মনোনয়নকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠছে। দলের তৃণমূলে মনোনয়ন বাণিজ্যের সৃষ্টি হয়েছে। ৩০০ সংসদীয় আসনে প্রার্থী বাছাইয়ে যেভাবে খোঁজখবর নেওয়া সম্ভব হয়, চার হাজার ৫৭১ ইউনিয়নে প্রার্থী মনোনয়ন দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের পক্ষে সেভাবে যাচাই করা সম্ভব হয় না। এসব কারণে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা চলছে।
আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, দলের অনেক সংসদ সদস্যই ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকুক, তা চাইছেন না। একজনকে মনোনয়ন দিতে গিয়ে তৃণমূলে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ করেন এমন অনেকের সঙ্গে সংসদ সদস্যের শত্রুতা সৃষ্টি হচ্ছে। আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড যতই গোয়েন্দা রিপোর্ট বা অন্যভাবে তথ্য সংগ্রহ করে মনোনয়ন দিক না কেন, মনোনয়নবঞ্চিতরা ভাবেন এটা সংসদ সদস্যই করলেন। আবার নৌকা প্রতীক নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে অনেকেই নানা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এর দায় এসে পড়ছে সরকারের ওপর। স্থানীয় সরকারের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের একজন প্রতিনিধির অনিয়মের প্রভাব পড়ছে জাতীয় পর্যায়ে।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সভায় দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু জানান, ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নৌকা প্রতীক বরাদ্দের ফলে তৃণমূলে দলীয় কোন্দল বাড়ছে। বৈঠকে সভাপতিমণ্ডলীর একাধিক সদস্য আবদুল মতিন খসরুর বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। এ সময়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজের নির্বাচনী এলাকা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বিভিন্ন ইউনিয়নে মনোনয়ন দিতে গিয়ে একই ধরনের সমস্যার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাঁর কাছেও অনেকে এসেছেন। সবাই নৌকা চান। সে জন্য তিনি দলীয় প্রার্থিতা উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
সূত্রগুলো জানায়, কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে দীর্ঘদিন সংসদ সদস্য ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ২০১৩ সালে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে আসনটিতে তাঁর ছেলে রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিগত ইউপি নির্বাচনে দলীয় চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়ন দিতে গিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে এই সংসদ সদস্য ও তাঁর পরিবার। পরে অষ্টগ্রাম, ইটনা ও মিঠামইন উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রাখা হয়।
আওয়ামী লীগের একাধিক সংসদ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, অনেকে মনে করেন নৌকা পেলেই তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন। দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের প্রস্তাব কেন্দ্রে আসে ইউনিয়ন থেকে উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগ হয়ে। ফলে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে নিজের নাম পাঠাতে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা তৃণমূলের নেতাদের বড় অঙ্কের টাকার দাবি মেটাতেও পিছপা হন না। তৃণমূলের নেতাদের ম্যানেজ করতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা লেনদেন হয়। কিন্তু ইউপিতে সরকারের তেমন বরাদ্দ থাকে না। ফলে চেয়ারম্যানরা তাঁদের মনোনয়নের পেছনে করা খরচের টাকা তুলতে গিয়ে ত্রাণ চুরি কিংবা বয়স্ক ভাতার মতো সামাজিক কল্যাণের টাকা নয়ছয় করেন। এতে তৃণমূলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। অনেক সংসদ সদস্য ভালো কাজ করেও সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারছেন না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর এলাকায় নৌকার ভোট অন্য দলের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সেখানে আওয়ামী লীগ থেকে যদি তিন-চারজনও নির্বাচন করে, তবু অন্য দলের প্রার্থীর জয়ের সম্ভাবনা নেই। ফলে এ ধরনের ইউনিয়নগুলোতে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন না দিয়ে উন্মুক্ত রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী না দেওয়াটা তাঁদের জন্য ভালো হবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ইউপিতে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে এমপিরা যুক্ত নন। এর পরও অনেকে ভুল বুঝে থাকেন। আমার নির্বাচনী এলাকায় যোগ্যরাই মনোনয়ন পেয়ে থাকেন। ফলে আমার এলাকার এ নিয়ে সমস্যা হয় না। তবে কোনো কোনো এমপির এলাকায় এ নিয়ে কিছুটা সমস্যা হয়।’
তবে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের সরে আসার সম্ভাবনা নেই জানিয়ে দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা দলীয় সিদ্ধান্ত নিয়েই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের দলীয় মনোনয়ন দিচ্ছি। নৌকা প্রতীকেই আমাদের প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগে প্রার্থী বাছাইয়ে সংসদ সদস্যদের মত নেওয়ার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। এটা তৃণমূল আওয়ামী লীগ দেয়।’