করোনার কারণে আটকে থাকা এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ব্যাপারে অবশেষে সিদ্ধান্ত এলো—এ বছর পরীক্ষা নেওয়াই হবে না। এর পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও মাধ্যমিক পরীক্ষার (এসএসসি) ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। গতকাল বুধবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। পরীক্ষা না নেওয়ায় এবার কোনো ফেল থাকছে না, প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করবে।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা সরাসরি গ্রহণ না করে ভিন্ন পদ্ধতিতে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরা দুটি পাবলিক পরীক্ষা অতিক্রম করে এসেছে। এদের জেএসসি ও এসএসসির ফলের গড় অনুযায়ী এইচএসসির ফল নির্ধারণ করা হবে।’

তিনি জানান, যারা এইচএসিতে বিভাগ পরিবর্তন করেছে, তাদের মূল্যায়নের জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি করা হয়েছে। কমিটির মতামতের ভিত্তিতে বিভাগ পরিবর্তনকারী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে এইচএসসির চূড়ান্ত মূল্যায়ন শেষ করা হবে। যাতে জানুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরু করা যায়। আমরা এবার বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তিপ্রক্রিয়া চালু করার চেষ্টা করছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে পরীক্ষা হবে না ফলাফলের ভিত্তিতে হবে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই ঠিক করবে।

গত ১ এপ্রিল থেকে এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল, যাতে অংশ নেওয়ার কথা ছিল প্রায় ১৪ লাখ পরীক্ষার্থীর। কিন্তু দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেওয়ার পর ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষাও আটকে যায়। বছর প্রায় শেষ হয়ে আসায় এ পরীক্ষা নিয়ে উদ্বেগ ছিল শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। এ পরিস্থিতিতে কিভাবে পরীক্ষা নেওয়া যায়, তা নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক আর নানা পরিকল্পনা চলে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর শিক্ষামন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, পরীক্ষা ছাড়া মূল্যায়ন করার একটা সম্ভাবনা তো থেকেই যাচ্ছে। আমরা সেটাকে নাকচ করে দিচ্ছি না। আমাদের অন্য অপশনও আছে। যাতে কোনো শিক্ষার্থীকে চাকরির জায়গায় গিয়ে শুনতে না হয়, ‘ও তুমি টোয়েন্টি টোয়েন্টি ব্যাচ। তুমি তো পরীক্ষা দিয়ে পাস করোনি। কাজেই তোমার এই এইচএসসির ফলাফলটাকে গুরুত্ব দিলাম না।’ এমন যাতে না হয়। কাজেই আমাদের যদি পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে সূচি ঘোষণার অন্তত চার সপ্তাহ পর পরীক্ষা নেওয়া হবে। দ্রুততম সময়ে পরীক্ষা শেষ করা হবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা সোম-মঙ্গলবার জানানো হবে।

সূত্র জানায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনায় পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। তারা পূর্ণমান কমিয়ে সংক্ষিপ্ত সময়ে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তে পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এলো মন্ত্রণালয়।

আগের সংবাদ সম্মেলনের বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে মন্ত্রীকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘অনেক কিছুই হতে পারত। কী হতে পারত তা এখন ভাববার সময় নয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ ভালো কী করতে পারি সেই চেষ্টা আমরা করছি।’ অপর এক প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘গতবার যারা ফেল করেছে, তাদেরও জেএসসি ও এসএসসির ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে।’

এইচএসসি পরীক্ষার আগে টেস্ট পরীক্ষাকে কেন মূল্যায়ন করা হচ্ছে না—এ প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, পরীক্ষায় যত ভালো প্রস্তুতি থাকে, টেস্টে অত ভালো প্রস্তুতি থাকে না। এই মুহূর্তে টেস্টের ফলাফল নিতে গেলে নানা সমস্যা হতে পারে। আমাদের হাতে তো দুটি পরীক্ষার ফল রয়েছে। সে কারণেই এই দুটি ফলের ওপর ভিত্তি করে এই ফল দিতে যাচ্ছি।’

মন্ত্রী বলেন, কভিড-১৯ পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হবে তার নিশ্চয়তা নেই। কখন পরীক্ষা নেওয়া যাবে বলা কঠিন। পরীক্ষা গ্রহণ করতে ৩০ থেকে ৩২ কর্মদিবস প্রয়োজন হবে। কভিড পরিস্থিতিতে এক বেঞ্চে দুজন বসানো সম্ভব নয়। প্রশ্নের নতুন প্যাকেট করারও সুযোগ নেই। বিষয় কমানো হয়তো যায়, কিন্তু প্রতিটি বিষয়ের গুরুত্ব রয়েছে। অনেকে এতে ক্ষতিগ্রস্ত মনে করতে পারবে। কভিড আক্রান্ত হলে তখন কী হবে? এ নিয়ে আমরা চিন্তা করছি। ভারতের পরীক্ষাও আমরা দেখেছি। তিনটি পরীক্ষা নেওয়ার পর তাদের পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। অনেক দেশ পরীক্ষা বাতিল বা স্থগিত করেছে।

যেসব শিক্ষার্থী গ্রুপ পরিবর্তন করে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে তাদের মূল্যায়ন কিভাবে হবে তা নিরূপণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করবে বলে জানান মন্ত্রী। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে ওই কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের প্রতিনিধি এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানরা থাকবেন। ওই কমিটি মূল্যায়নের পদ্ধতি বের করে আগামী নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মতামত দেবে। তাদের মতামতের ভিত্তিতেই বিভাগ পরিবর্তনকারী শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হবে।

দেশের ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ও মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৭৮৯ জন পরীক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে নিয়মিত পরীক্ষার্থী ১০ লাখ ৭৯ হাজার ১৭১ জন। অনিয়মিত পরীক্ষার্থী রয়েছে দুই লাখ ৬৬ হাজার ৫০১ জন। এক বিষয়ে অনুত্তীর্ণ এক লাখ ৬০ হাজার ৯২৯ জন, দুই বিষয়ে অনুত্তীর্ণ ৫৪ হাজার ২২৪ জন এবং সব বিষয়ে অনুত্তীর্ণ ৫১ হাজার ৩৪৮ জন পরীক্ষার্থী রয়েছে এবার। নিয়মিত-অনিয়মিত পরীক্ষার্থীর বাইরে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী রয়েছে তিন হাজার ৩৯০ জন। মানোন্নয়ন পরীক্ষার্থী রয়েছে ১৬ হাজার ৭২৭ জন।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক প্রমুখ।