শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার সবচেয়ে বেশি জটিল। তবে শুরুতে শনাক্ত করে চিকিৎসা নিলে এই জটিলতা এড়ানো যায়। লিখেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এ কে এম মোশাররফ হোসেন

কারণ
বয়স : ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে সাধারণত ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে আরো কম বয়সেও এই রোগ দেখা দিতে পারে।

পরিবেশ : রাসায়নিক বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শ এবং পরিবেশদূষণকারী জিনিস, যেমন—সিগারেটের ধোঁয়া, অ্যাসবেস্টস, রেডন, আর্সেনিক, বিকিরণ ও অন্যান্য দূষণ।

পরোক্ষ ধোঁয়া : অন্যের দ্বারা উৎপাদিত ধোঁয়ায় শ্বাস নিলে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

অ্যাসবেস্টস : যাঁরা পদার্থ নিয়ে কাজ করেন তাঁদের আশঙ্কা বেশি।

বায়ুদূষণ : নানা কারণে বায়ুদূষণ হয়, আর এর প্রতিক্রিয়ায় ক্যান্সার বাসা বাঁধতে পারে দেহে।

লক্ষণ
ফুসফুস ক্যান্সারের উপসর্গ আর লক্ষণ সবার ক্ষেত্রে একরকম নয়। সাধারণভাবে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি কাশি, কাশির সঙ্গে কফ বা রক্ত, শ্বাসকষ্ট, আক্রান্তের শুরুতে বুকে ব্যথা, হালকা জ্বর, খাদ্যে অনীহা, ওজন হ্রাস ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে ফুসফুস ক্যান্সারের কিছু

লক্ষণ হলো :
♦ এমন কাশি, যা সহজে দূর হয় না।

♦ বুকে ব্যথা, যা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস, কাশি বা হাসতে গেলে আরো কষ্ট হয়।

♦ ওজন হ্রাস ও ক্ষুধামান্দ্য।

♦ থুথু বা কফের সঙ্গে রক্ত যাওয়া।

♦ নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া বা দুর্বলতা।

♦ ক্লান্ত বা দুর্বল লাগা।

♦ ফুসফুসের সংক্রমণ, যেমন—ব্রংকাইটিস বা নিউমোনিয়া, যা ক্রনিক বা পুনরাবৃত্তি হয়ে যায়।

রোগ নির্ণয়
এক্স-রে : কারোর ফুসফুসে ক্যান্সার হয়েছে কি না তা নির্ণয়ের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা হলো এক্স-রে। যেকোনো ব্যক্তির, বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ্ব, ধূমপায়ীর দীর্ঘমেয়াদি কাশি হলে অবশ্যই এক্স-রে করা উচিত।

শ্লেষ্মার সাইটোলজি : রোগীর কফ বা শ্লেষ্মায় ক্যান্সার কোষ আছে কি না তা এই পরীক্ষায় জানা যায়।

বুকের সিটি স্ক্যান : এক্স-রের চেয়ে আরো সূক্ষ্মভাবে ফুসফুসের ক্ষত ধরা পড়ে সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে।

ব্রংকোসকপি : এই যন্ত্রের সাহায্যে শ্বাসনালির ভেতরের ক্যান্সার টিস্যুর বায়োপসি নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। আবার ব্রংকোসকপির সঙ্গে আল্ট্রাসাউন্ড যন্ত্র যুক্ত করে শ্বাসনালির কাছের লিম্ফনোড থেকে রস নেওয়া যায়, যাকে বলে ইবাস (ঊইটঝ)।

এফএনএসি : যদি টিউমার ব্রংকোসকপিতে না পাওয়া যায়, তখন এই পরীক্ষার সাহায্যে ফুসফুসের ক্ষত থেকে রস নিয়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়।

পেট স্ক্যান : পেট স্ক্যান পরীক্ষা সাধারণ সিটি স্ক্যানের চেয়ে আরো সূক্ষ্ম। তবে টিবি রোগের জন্য পেট পজিটিভ রিপোর্ট দিতে পারে। এ ব্যাপারে সতর্ক থেকে পেট স্ক্যানের রিপোর্ট করতে হবে।

এ ছাড়া প্লুরাল ইফিউশন, লিম্ফনোড বায়োপসি ইত্যাদি পরীক্ষায়ও ফুসফুসের ক্যান্সার নির্ণয় হয়।

চিকিৎসা
সার্জারি : ফুসফুসের টিউমার অপসারণের জন্য সার্জারি করা হয়। ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে সার্জারির মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ টিউমার অপসারণ করা যায়। অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সারের মধ্যপর্যায়েও সার্জারি করা হয়।

তবে ফুসফুস ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ৪০ শতাংশেরও কম রোগীকে সার্জারি করা হয়। ফুসফুস ক্যান্সারের জন্য সার্জারি হলো প্রধান চিকিৎসা। তবে এটা নির্ভর করে টিউমারের ধরন, আকৃতি, অবস্থান এবং রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর।

রেডিয়েশনথেরাপি : দুই ধরনের রেডিয়েশন থেরাপির মধ্যে রয়েছে—ইরেডিয়েশন ইন ক্যাভিটি, ইরেডিয়েশন ইন ভিট্র। এক্স-রে মেশিন, কোবাল্ট বোম, অ্যাকসেলারেটর প্রভৃতির সাহায্যে রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়। রেডিয়েশন পদ্ধতির সর্বাধুনিক সংযোজন হলো ‘ফোটন নাইফ’ পদ্ধতি।

সার্জারির পূর্ববর্তী ও পরবর্তী চিকিৎসা হিসেবেও রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। স্কোয়াস সেল কারসিনোমার ক্ষেত্রে সার্জারি করা সম্ভব হয় না, সে ক্ষেত্রেও রেডিওথেরাপি ব্যবহৃত হয়।

রেডিওথেরাপিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—সিম্পল রেডিওথেরাপি ও কমপ্রিহেনসিভ রেডিওথেরাপি। সিম্পল রেডিওথেরাপির মধ্যে রয়েছে, র‌্যাডিক্যাল রেডিওথেরাপি ও প্যালিয়েটিভ রেডিওথেরাপি। কোন ধরনের থেরাপি দেওয়া হবে তা নির্ভর করে রোগীর শারীরিক অবস্থা, টিউমারের ধরন, অবস্থান ইত্যাদির ওপর। কমপ্র্রিহেনসিভ রেডিওথেরাপিতে সার্জারি ও কেমোথেরাপির সঙ্গে রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। একক চিকিৎসার তুলনায় এগুলোর সমন্বয় করে ট্রিটমেন্ট করা হলে কার্যকারিতা আরো বেড়ে যায়।

প্রতিরোধে করণীয়
ফুসফুস ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য নয়, তবে প্রতিরোধযোগ্য। মূলত সচেতনতাই এই ক্যান্সার প্রতিরোধের প্রধান উপায়।

এ জন্য কিছু করণীয় হলো :
♦ প্রথমে ধূমপান ত্যাগ করতে হবে। এটা হলো প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

♦ সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। খাবার মেন্যুতে তাজা ফলমূল ও শাকসবজি নিয়মিত রাখা উচিত।

♦ শিল্প-কারখানা ও গাড়ির নির্গত কালো ধোঁয়া থেকে বিরত থাকা উচিত।

♦ বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ, যেমন : ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, অ্যাসবেস্টস ইত্যাদি এড়িয়ে চলতে হবে।

♦ ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ, যেমন : যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া ভালো হওয়ার পর ফুসফুসের আক্রান্ত স্থানে ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। তাই যথাসম্ভব সতর্ক থাকা উচিত।