করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত আট মাস বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চলতি সপ্তাহ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স ফাইনাল সেমিস্টারের ব্যাবহারিক ক্লাস-পরীক্ষা গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে স্কুলে আসছে। এ অবস্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষক। অবশ্য আগামী ১৪ নভেম্বরের পর সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার।

বিশ্বের অনেক দেশই করোনার প্রথম পর্যায় শেষ হওয়ামাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। কোনো কোনো দেশ আবার কিছুদিন যেতে না যেতেই পুনরায় বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। তবে অনেক দেশই করোনার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেছে। ইংলিশ মিডিয়াল স্কুলের অক্টোবর-নভেম্বরের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা সারা বিশ্বেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। তাঁদের বেশির ভাগই স্কুল খোলার পক্ষে। তবে আমার মত, একটি ক্লাসে ৬০ জন শিক্ষার্থী থাকলে তাদের তিন ভাগে ভাগ করে স্কুলে আনা যেতে পারে। প্রয়োজনে শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে দুই দিন স্কুলে আসবে। পাশাপাশি অনলাইনে ক্লাস চলবে। তাতে করে শিক্ষার্থীদের মানসিক অস্থিরতাও দূর হবে।’

মোহাম্মদপুরের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. রহমত উল্লাহ বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে ওপরের ক্লাসগুলো আগে খুলে পরিস্থিতি দেখা উচিত। সরকার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার যে চিন্তা-ভাবনা করছে তা সম্পূর্ণই সঠিক। এই ক্লাসগুলোকে পরীক্ষামূলক হিসেবে ধরে পরবর্তী ক্লাসগুলো খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।’

ময়মনসিংহের মাইজবাড়ী টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ আশফাক উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই পড়ালেখা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থীরা কিন্তু নিয়মিতই বাড়ির বাইরে বের হচ্ছে। আমার মনে হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সময় এসেছে। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার্থীদের কয়েক ভাগে ভাগ করে ক্লাস নিতে পারব।’

রাজধানীর মনিপুর উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘প্রত্যেক শ্রেণিতে ৮০ জনের ওপরে শিক্ষার্থী রয়েছে। স্কুলে প্রবেশ ও ছুটির সময় প্রচণ্ড জটে পড়তে হয়। করোনাকালে এসব চিন্তা করলে ভয় হয়। এখন স্কুল খুললেও ব্যক্তিগতভাবে আমি আরো কিছুদিন সন্তানকে স্কুলে পাঠাব না। তবে এটাও ঠিক, স্কুল না খুললে পড়ালেখা হচ্ছে না।’

জানা যায়, প্রায় ৫০ হাজার কিন্ডারগার্টেনের ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী করোনা দুর্যোগে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। ফেব্রুয়ারির পর থেকে শিক্ষকদের বেতন বন্ধ। কয়েক হাজার স্কুল এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। এসব স্কুলের শিক্ষার্থীরাও আট মাস ধরে পড়ালেখার বাইরে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, ‘দেশের অফিস-আদালত, মার্কেট, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, পার্ক সর্বত্র লোক সমাগম স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কওমি মাদরাসা খুলেছে। ইংলিশ মিডিয়ামের পরীক্ষা হচ্ছে। তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিন্ডারগার্টেন স্কুল খুলতে বাধা কোথায়? অবিলম্বে কিন্ডারগার্টেন খোলার অনুমতি না দিলে আগামী ১০ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে আমরা বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা করব।’

করোনায় আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি), স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা এবং এইচএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাও এরই মধ্যে বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু আট মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসির শিক্ষার্থীরা তাদের সিলেবাস শেষ করতে পারছে না। ফলে সরকার তাদের জন্য হলেও সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা ভাবছে।

গত ২৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, ‘আগামী দুই সপ্তাহ পর আমরা চেষ্টা করে দেখব, সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায় কি না। তবে সবই নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর। আগামী বছর যারা এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দেবে, তাদের কথা বিবেচনায় রেখে খুবই সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা যায় কি না তা আমরা চিন্তা-ভাবনা করে দেখছি।’

জানা যায়, পর্যায়ক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তা রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। সে ক্ষেত্রে আগে বিশ্ববিদ্যালয় এবং এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্য স্কুল-কলেজ খোলা হতে পারে। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে চারজনের একটি রুমে আট থেকে ১২ জন থাকেন। মেসে থাকা শিক্ষার্থীরাও এক রুমে চারজনের কম থাকেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় খুললে এসব শিক্ষার্থীর পক্ষে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, যা চিন্তার বিষয়। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হল না থাকায় তাদের পক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস নেওয়া সম্ভব।