তিল তিল করে গড়ে ওঠা কাতারি ফুটবল ঐতিহ্যের সঙ্গে রং হারানো বাংলাদেশ ফুটবলের লড়াই। খুব সরল করে বললে অসম লড়াই। অথচ সত্তরের দশকে প্রায় একই সমতলে দাঁড়ানো দল দুটির কী অবিশ্বাস্য বাঁকবদল হয়েছে। ফুটবল সংস্কার ও অর্জনের মধ্য দিয়ে কাতার এভারেস্টের চূড়ায় উঠে দেখছে পাদদেশে লড়ছে বাংলাদেশ। লাল-সবুজের উত্তরণ কিছুই হয়নি। ১৯৭৯ সালে কাতারের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করা লাল-সবুজের জন্য এখন ড্রয়ের বাস্তবতা নেই। উল্টো লক্ষ্য থাকে ব্যবধান যতটা সম্ভব কমানোর। দোহায় আজও বাংলাদেশ দলের অভিন্ন লক্ষ্য—নিজেদের পোস্টের সুরক্ষাব্যূহ তৈরি।

ইতিহাসের ধারা বজায় থাকলে আজ এমন দুরু দুরু বুকে মাঠে নামতে হয় না বাংলাদেশের। জন্মের সঙ্গেই এ দেশটি পেয়েছিল ফুটবলের ঐতিহ্য, পাকিস্তান অনেক কিছু লুটে নিলেও অটুট ছিল বাঙালির ফুটবল ঝলক। সুবাদে এটাই ছিল গণমানুষের বিনোদনের বড় উপলক্ষ। অযত্ন-অবহেলায় তার আজ এই দুর্দশা। অথচ এমন ঐতিহ্য কাতারের ছিল না। প্রকৃতির উপহার তেল-গ্যাসে সমৃদ্ধ এই দেশে অর্থ-বিত্তের অভাব নেই। এ রকম বৈভবে ভরপুর মধ্যপ্রাচ্যের আরো কয়েকটি দেশ, যেখানে জীবন উপভোগের সব রকমের রসদ আছে। তাদের চেয়ে একটু আলাদা করে ভেবেছে কাতার। নিজেদের ‘স্পোর্টিং নেশন’ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছে, যেন ক্রীড়া সাফল্যে কাতার আলাদা চমক হয়ে ওঠে বিশ্ববাসীর কাছে। তাই খেলাধুলায় তাদের প্রচুর বিনিয়োগ। আগে থেকেই বৈশ্বিক ক্রীড়ার আসর বসছে দোহায়, সামনে আছে বিশ্ব ক্রীড়ার সবচেয়ে মোহনীয় বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২। তারা সম্পর্ক গড়েছে বিশ্বের নামি-দামি ক্লাবগুলোর সঙ্গে। ২০১১ সালে প্রথম বার্সেলোনার স্পন্সর হয় কাতার ফাউন্ডেশন, এরপর পিএসজি কিনে নিয়েছে কাতারেরই এক ধনকুবের। এ ছাড়া কাতারি এসপায়ার একাডেমি শাখা খুলেছে ইউরোপ-আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে।

তবে কাতার সমস্যায় পড়েছিল মাত্র ৩০ লাখেরও কম জনসংখ্যা নিয়ে। জনসংখ্যার অনুপাতে খেলোয়াড়ের সংখ্যাও বাড়ে, তাদের জনসংখ্যা কম হওয়ায় খেলোয়াড়ও কম। তাই ফিফার অভিবাসন আইনের মধ্যে থেকে বিভিন্ন দেশের ফুটবলারদের নাগরিকত্ব দিয়েছে তারা। ফ্রান্স, পর্তুগাল, সুদান, ঘানাসহ ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন দেশের ভালো ফুটবলারদের পেট্রো ডলারের বিনিময়ে নিয়ে এসেছে নাগরিকত্ব দিয়ে। সুবাদে কাতার এখন এশীয় ফুটবল পরাশক্তি, জিতেছে ২০১৯ এশিয়ান কাপ ফুটবল। যদিও ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর অভিবাসীদের চেয়ে তারা আসল কাতারি ফুটবলারদের দিকে ঝুঁকেছে বেশি। ভাড়াটেদের মধ্যে নাকি জাতীয়তাবোধের অভাব হয়, লড়াইয়ে খামতি থাকে। এর পরও কাতারি ফুটবল শক্তির মূল উত্স ওই ভিনদেশিরাই। যেমন সুদানের আলমোয়েজ আলী এখন কাতারি আক্রমণের মূল অস্ত্র। ৯ গোল করে এশিয়ান কাপ ফুটবলের এই সেরা গোলদাতাকে ঠেকাতেই আজ হিমশিম খাবে বাংলাদেশের রক্ষণভাগ। ডিফেন্ডার তপু বর্মন যদিও বাংলাদেশের রক্ষণ সংগঠন আগের চেয়ে ভালো বলে দাবি করছেন, ‘দলে এখন সবাই ফিট, রক্ষণভাগের বোঝাপড়াও আগের চেয়ে ভালো এখন। প্রথমার্ধ কোনোভাবে ঠেকিয়ে রাখতে পারলে সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত হবে।’ দেশে গত মাসে নেপালের বিপক্ষে দুটি ম্যাচে বাংলাদেশ কোনো গোল না খেলেও কাতারে দুটি ওয়ার্ম আপ ম্যাচে খেয়েছে চার গোল। সুতরাং গোলের ভয়টা থেকেই যাচ্ছে।

ভয় তাড়ানোর অনুপ্রেরণা হতে পারে কাতার-ভারত ম্যাচটি। করোনার আগে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে কাতারে গিয়ে ম্যাচ ড্র করেছিল ভারত। ২৭ শটের মধ্যে ১১টি সেভ করে জীবনের ‘সেরা ম্যাচ’ খেলেছেন গুরুপ্রীত সিং। এই ভারতীয় গোলরক্ষকের কৃতিত্বের কথা জানেন বাংলাদেশের গোলরক্ষক আশরাফুল রানা। সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছেন যে ম্যাচে ঝড় বয়ে যাবে তাঁর ওপর, ‘আমাদের আসল লড়াই হবে কাতারি আক্রমণভাগের সঙ্গে। আমি অবশ্যই সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করব। অমন চাপের মধ্যে নিজেকে ঠিকঠাক রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে গোলরক্ষক ও রক্ষণের দিকে চেয়ে থাকলে হবে না, সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়তে হবে।’ এত দিন দোহায় বাংলাদেশ দলের ট্রেনিংয়ের মূল সুরই ছিল প্রতিরোধ। কী করে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নদের তোপ সামলে ৯০ মিনিট পার করা যায়। রক্ষণ-লাইন ঠিক রাখতে হবে, মধ্যমাঠ থেকে তাদের ‘ব্লক’ করতে হবে, প্রস্তুতি ম্যাচের ভুলগুলো করা যাবে না।

এত ট্রেনিং ও সতর্কীকরণের পরও ভুল হবে। সেটা হয় বলেই প্রতিপক্ষ ম্যাচ জেতে। তাই কাতারি ‘পেট্রো ডলার’ ফুটবলের বিপক্ষেও ভুল হতে পারে, তবে সেটা জামাল ভূঁইয়াদের জন্য খুব বেশি বিব্রতকর যেন না হয়।