মাহফুজ বাবু;


জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা ও আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গোমতীর চরে অবাধে চলছে উর্বর কৃষি জমির মাটি লুটের মহোৎসব। রিতিমত যেন মাটি কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেছে মাটি খেকো সিন্ডিকেট। সাম্প্রতিক সময়ে জেলা প্রশাসনের অব্যাহত একাধিক অভিযানে সেই উৎসবে কিছুটা ভাটা পরেছে। চলমান ধরপাকড় ও জেল জরিমানার ভয়ে অনেকেই সটকে পরেছেন অবৈধ মাটি উত্তোলন ব্যবসা গুটিয়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও প্রশাসনকে বৃদ্ধিঙ্গুলি দেখিয়ে, প্রকাশ্যেই দিনে এবং রাতভর কাটা হচ্ছে আবাদী ও ফসলি জমিগুলোর মাটি। গোমতী নদীর দুই তীরের বিস্তীর্ন চরের উর্বর পলি মাটি স্থানীয় কৃষক এবং খেটে খাওয়া দরিদ্র বর্গা চাষিদের জন্য আশীর্বাদ। তবে সেই গোমতীর চরই এখন কৃষকদের জন্য অভিশাপ ও হাহাকারের কারনে পরিনত হয়েছে মাটি খেকোদের কারনে। কুমিল্লা গোমতী নদীর ৫৮ কিলোমিটার আংশের ২শতাধিক পয়েন্ট থেকে প্রতিদিনই হাজারো ট্রাক্টর, ট্রাক, ড্রামট্রাকে করে ড্রেজার ও দানব ভেকু মেশিনে কাটা মাটি জেলার ব্রিকসফিল্ড সহ বিভিন্ন জলাশয় ও পুকুর ভরাটের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গোমতী চরের আদর্শ পলিমাটিতে যে কেন ফসল ভালো হয়। আর এই মাটি কেটে নেয়ার ফলে হেক্টরের পর হেক্টর আবাদি জমি ধ্বংস হচ্ছে।

শুধু চরই যে ধ্বংস হচ্ছে তা নয়, বালুবাহী হাজারো ভারি পরিবহনের বেপরোয়া চলাচলের কারনে গ্রামীন জনপদের দুর্বল অবকাঠামোয় নির্মিত রাস্তা ঘাট ধংস হচ্ছে বছর না ঘুরতেই। হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত শহর প্রতিরক্ষা বাঁধ ও ব্রিজগুলো পরছে হুমকির মুখে। এছাড়াও রয়েছে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের আশংকাও, সেই সাথে পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর বিরুপ প্রভাব তো পরছেই। সম্ভাবনাময় গোমতী, প্রকৃতিক সৌন্দর্য্যের গোমতীর সবুজ চর ক্ষত বিক্ষত বিরান ভূমিতে পরিনত হচ্ছে দিনের পর দিন। আদর্শ সদরের মাত্র ৬পয়েন্টে নদী থেকে বালু উত্তোলনের ইজারা নিয়ে দুই তীরের চরে প্রায় ৬৫টি থেকে দেদারসে কাটা হচ্ছে কৃষি জমির মাটি। মাটিখেকোরা প্রভাবশালী হওয়ায় ভয়ে প্রতিবাদও করতে পারছে না ভুক্তভোগী কৃষকরা।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে গোমতী চরের এমন চিত্রই নজরে আসে নবাগত জেলা প্রশাসক কামরুল ইসলাম এর। এরপরই নড়েচড়ে বসে জেলা প্রশাসন। এবার ইজারার মেয়াদ শেষে আগামীতে নতুন করে বালু মহাল ইজারা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। সেই সাথে চরের মাটি কাটা বন্ধে কঠোর ভুমিকা গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে একাধিক টিম দিনে এবং গভীর রাতে বেশকিছু মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। বিভিন্ন সময় চরজুড়ে পরিচালিত এসব অভিযানে মাটিবাহী ড্রামট্রাক, ট্রাক্টর, ভেকু ও ড্রেজার জব্দ করা হয়। গত কয়েকদিনের এসকল অভিযানে মাটিকাটারত অবস্থায় আটক করা হয় ১০জনকে। অবৈধ ভাবে মাটি কাটার অপরাধে মোবাইল কোর্টে বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও প্রদান করা হয় তাদের। এছাড়াও মাটি বহনের জন্য অবৈধভাবে নির্মাণকরা বাঁধের সাথে সংযুক্ত ডাইবেশন সড়কগুলো বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসক কামরুল ইসলাম এর সার্বিক নির্দেশনায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মোঃ আবু সাইদ, জনী রায়, ফয়সাল আহাম্মদ, অমিত দত্ত সহ অন্যান্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণের নেতৃত্বে জেলা পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, আনসার ও সিটি কর্পোরেশন নিয়মিত সহায়তায় অভিযান চলমান থাকবে বলেও জানায় জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানা যায়, গোলাবাড়ি সীমান্ত থেকে গোমতীর কুমিল্লা অংশের পুরো ৫৮ কিলোমিটার এলাকয় নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন উপজেলা প্রশাসনকে অবৈধভাবে মটিকাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে অবৈধভাবে মাটি উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে জেল জরিমানা সহ কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানানো হয়েছে।

এদিকে জেলা প্রশাসনের লাগাতার অভিযানের ফলে আদর্শ সদর উপজেলার গেমতী চরের বেশকিছু এলাকায় অবৈধ মাটি কাটাও বন্ধ হয়েছে। চরের স্থানীয় ভুক্তভোগী কৃষকরা জেলা প্রশাসনের এমন অভিযানকে স্বাগত জানিয়ে অভিযান অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।

চরের কৃষকদের অনেকে অভিযোগ জানিয়ে বলেন, সামান্য টাকা দিয়ে কিংবা রাতে জোর করেই কেটে নেয়া হয় ফসলসহ জমির মাটি। বাঁধা দিলেই হতে হয় নির্যাতিত। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও শক্তিশালী মাটি খেকো সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও প্রতিকার পাচ্ছিলেন না ভুক্তভোগীরা। দেখা যায়, নির্দিষ্ট পয়েন্টে নদী থেকে বালু উত্তোলনের ইজারা নিয়ে নদীর বালু না তুলে কেটে নেয়া হয় ফসলী জমি। প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার মাটি বিক্রি হয় গেমতীর এসকল চর থেকে।
স্থানীয় কৃষকদের দাবি অবৈধ ভাবে ফসলি জমির মাটি কাটা স্থায়ী ভাবে বন্ধ করতে মাটি খেকোদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে এসব অপকর্ম বন্ধ হবে। সেই সাথে আবাদী জমিগুলো রক্ষার পাশাপাশি গোমতীর সৌন্দর্য, বাঁধ ও ব্রীজ সহ পরিবেশ রক্ষা পাবে।

জেলা প্রশাসক কামরুল ইসলামের ইতিমধ্যেই গোমতীর মাটিকাটার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। অবৈধ মাটি উত্তোলনের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করে তিনি জানান, এভাবে কৃষি জমি অবাধে ধ্বংস করে গোমতীর চর থেকে অবৈধ ভাবে কাউকে মাটি উত্তলোন করতে দেয়া হবে না। এবিষয়ে কাউকেই কোনরূপ ছাড়া দেয়া হবে না। জনকল্যাণ ও গোমতী রক্ষায় জেলা প্রশাসনের এ অভিযান নিয়মিত চলমান থাকবে।