মোঃ ইমন হোসেন, ক্রাইম রিপোর্টার
চট্টগ্রামের পটিয়াজুড়ে চলছে হুইপ সামশুল হক চৌধুরী ও তাঁর পরিবারের অপরাধ রাজত্ব। হুইপের পুরো পরিবার অক্টোপাসের মতো গিলে খাচ্ছে পটিয়া ও এর আশপাশের এলাকা। একেকটি এলাকা একেকটি সেক্টরে ভাগ করে চলছে তাদের নিয়ন্ত্রণ ও চাঁদাবাজি। অন্ধকার এ রাজ্যের ‘রাজপুত্র’ হিসেবে আছেন হুইপের ছেল নাজমুল হক চৌধুরী শারুন। আর ‘রাজ্যপাল’ হিসেবে আছেন হুইপের ভাই নবাব ও মহব্বত এবং বোন রেখা। বাদ যাননি ভাগ্নে কিংবা নিকটাত্মীয়রাও।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পটিয়ার একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ করেন, পটিয়ায় হুইপ পরিবারের বাইরে গিয়ে অন্য কারো ব্যবসা করার সুযোগ নেই। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে গেলেই চলে হামলা ও মামলা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সামশুল হক চৌধুরী দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পর থেকে পটিয়া এলাকায় অপরাধের ডালপালা মেলতে থাকে তাঁর পরিবার। জাতীয় সংসদের হুইপ নির্বাচিত হওয়ার পর তা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করে। এর পর থেকে এলাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নকাজে রড, বালু, পাথর সরবরাহ, বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল ও শ্রমিক সরবরাহ, মাদক কারবারসহ সব সেক্টরে ভাগ বসান হুইপপুত্র ও তাঁর ভাই-বোনরা। এমনকি এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খুনের ঘটনাও ঘটেছে। এসব ঘটনার নেপথ্যে থাকার অভিযোগ রয়েছে হুইপ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে।
নাজমুল হক চৌধুরী শারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এলাকায় টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন গ্রহণ, কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ এবং অন্যান্য অপরাধীচক্রকে লালন করেন। পটিয়ার ইন্দ্রপুল, মেলিটারিপুল ও ভেল্লাপাড়া এলাকায় বড় বড় তিনটি বালুমহালের নিয়ন্ত্রণেও রয়েছেন শারুন। একটি বেসরকারি জাহাজ তৈরির ইয়ার্ড দখলের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। হুইপের ভাই ফজলুল হক চৌধুরী মহব্বতের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। বিরোধপূর্ণ জমি দখল, সালিস-বিচারের নামে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ, থানা ও উপজেলা প্রশাসনে অবৈধ প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ রয়েছে মহব্বতের বিরুদ্ধে। এ ছাড়া দক্ষিণ পটিয়ার পাঁচ ইউনিয়নের আবাদি ভূমির টপ সয়েল বিক্রি করা সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন তিনি। প্রতিদিন শতাধিক টপ সয়েল বহনকারী ট্রাক থেকে চার হাজার টাকা করে চাঁদা নেন তিনি।
হুইপের সাম্রাজ্যে বাস্তবিক অর্থে ‘নবাবের’ ভূমিকায় রয়েছেন আরেক ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী নবাব। পারিবারিক নানা ইস্যু নিয়ে একসময় নবাবের সঙ্গে দূরত্ব ছিল সামশুল হকের। কিন্তু ২০১৬ সালে বিরোধ ভুলে হুইপ সাম্রাজ্যে যোগ দেন নবাবও। এর পর থেকে শুরু হয় তাঁর বেপরোয়া কর্মকাণ্ড। এলাকার মাটি ভরাট সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে ইট, বালু, সিমেন্ট, পাথর সরবরাহ, পটিয়ায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় শ্রমিক সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেন নবাব। পটিয়ায় গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানাগুলোকে কাঁচামাল কিনতে বাধ্য করার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। শিল্প-কারখানায় কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার গাড়িও নিতে হয় তাঁর কাছ থেকে। এসব ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের কমপক্ষে পাঁচ নেতাকর্মী খুন হয়েছেন। এসব ঘটনার নেপথ্য হোতা হিসেবে নবাবকে দায়ী করা হয়। এ ছাড়া পটিয়ার জঙ্গলখাইন ইউনিয়নে ভূমি দখল করে নবাব গড়ে তুলেছেন বিশাল কৃষি খামার, যাতে তিনি বিনিয়োগ করেছেন কোটি কোটি টাকা।
হুইপের ভাইদের চেয়ে কোনো অংশে কম যান না তাঁর বোন রেখা। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে সংখ্যালঘুদের জায়গা দখল, থানায় সালিস-বিচারে প্রভাব বিস্তার এবং বিভিন্ন শিল্প-কারখানার শ্রমিক বহনকারী পরিবহন নিতে বাধ্য করার অভিযোগ। মামা-খালার চেয়ে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই হুইপের ভাগ্নে লোকমান খান। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে উপজেলা ও পৌরসভার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জায়গা দখল ও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ।