বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অবস্থা ‘আগের চেয়ে ভালো’ থাকলেও উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। এ জন্য পরিবারের পাশাপাশি তাঁর দল বিএনপির পক্ষ থেকেও সরকারের শীর্ষমহলকে রাজি করানোর চেষ্টা চলছে। সরকারের শীর্ষ ওই মহল ‘সবুজ সংকেত’ দিলেই তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করা হবে। এ ব্যাপারে সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে বলে জানা গেছে।

অবশ্য রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মনে করছেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশ নিতে হলে আদালতের অনুমতি লাগবে। যদিও তিনি বলেছেন, এ বিষয়ে সরকারই করণীয় ঠিক করবে।

এদিকে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা আগের দিন সোমবারের তুলনায় মঙ্গলবার (গতকাল) ভালো বলে জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল দুপুরে খালেদা জিয়াকে দেখতে তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে যান। বিকেলে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘ম্যাডামের (খালেদা জিয়ার) চিকিৎসকরা খুশি যে আগের দিনের চেয়ে তিনি ভালো আছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল এবং তাঁকে দুই লিটার পরিমাণ অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে।’

বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন গতকাল রাতে এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘উনার (খালেদা জিয়া) যেসব পরীক্ষা গতকাল (সোমবার) ও আজকে করানো হয়েছে, সেগুলো রিভিউ করেছেন মেডিক্যাল বোর্ডের সদস্যরা। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে উনি গতকাল যে অবস্থায় ছিলেন এখন সেই অবস্থায় আছেন।’ তিনি দেশবাসীর কাছে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তির জন্য দোয়া কামনা করেছেন।

সূত্র জানায়, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যেতে গতকাল পর্যন্ত সরকারের কাছে কোনো আবেদন করা হয়নি। রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিতে খালেদা জিয়া বা তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে কোনো আবেদন করেনি।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে কোনো সুবিধা নিতে হলে খালেদা জিয়াকে আদালতের মাধ্যমেই আসতে হবে।’

তবে বিএনপি মনে করে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাইলে অন্য কোনো কিছুই প্রতিবন্ধকতা নয়। পরিবার ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে করে খালেদা জিয়াকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে লন্ডনে তাঁর চোখের চিকিৎসা হলেও খালেদা জিয়ার অন্যান্য চিকিৎসা সিঙ্গাপুরেই বেশি হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশিদের সিঙ্গাপুরে প্রবেশের ব্যাপারে বিধি-নিষেধ আছে। সিঙ্গাপুরে সম্ভব না হলে তাঁকে লন্ডনে নেওয়ারই চেষ্টা হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে খালেদা জিয়ার নিজেরও সম্মতি আছে। সরকার অনুমতি দিলে তিনি বিদেশে যাবেন। যদিও তাঁর পাসপোর্টের মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। যে দেশেই যান, তাঁকে ভিসাও নিতে হবে। কিন্তু সরকার চাইলে এর সব কিছু দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব বলে মনে করে বিএনপি। এ জন্য সবার আগে সরকারের ‘সম্মতির’ প্রতি গুরুত্ব দিয়ে দলটি পর্দার আড়ালে অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বিএনপির পাশাপাশি খালেদা জিয়ার ভাই শামীম এস্কান্দারও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে কথা বলছেন।

উল্লেখ্য, আলাপ-আলোচনা পর্দার আড়ালে হলেও খালেদা জিয়ার কারামুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আবেদন খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকেই করা হয়েছে। ওই আবেদনের বরাতেই সরকারের নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে গত বছরের ২৫ মার্চ কারামুক্ত হন খালেদা জিয়া।

করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিলেও গত ২৮ এপ্রিল থেকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন খালেদা জিয়া। ১০ সদস্যের একটি মেডিক্যাল বোর্ড তাঁর চিকিৎসার বিষয়টি দেখাশোনা করছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলতে থাকার মধ্যেই হঠাৎ করে শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় গত ৩ মে তাঁকে সিসিইউয়ে (করোনারি কেয়ার ইউনিট) নেওয়া হয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল বললেও নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র কালের কণ্ঠকে জানিয়েছে, তাঁর ফুসফুসে কিছুটা পানি জমেছে। আগের দিন সোমবার তাঁর চার লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন হলেও গতকাল তা কমে দুই লিটারে নেমে আসে।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আমি বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্যগত বিষয়টি জানিয়ে ফোন করেছিলাম। বিদেশে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয়নি। এ ছাড়া পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনও করা হয়নি।’ ‘বিদেশে নিতে হলে সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরাই ঠিক করবেন’, বলেন মির্জা ফখরুল।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপি স্থায়ী কমিটির দুজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানোর অর্থ হলো সরকারকে বিষয়টি অবহিত করা। কোনো কারণে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হলে সরকার যাতে না বলতে পারে যে তাদের জানানো হয়নি।

দলের আরেক নেতা বলেন, উন্নত চিকিৎসার অভাবে খালেদা জিয়ার কিছু হয়ে গেলে এর দায়-দায়িত্ব সরকারের ওপরও বর্তাবে। সরকারকে তাঁরা ওই বিষয়টিই বোঝানোর চেষ্টা করছেন। এর আগে অনেকবার দেনদরবার করেও খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করা যায়নি। কিন্তু করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সময়ে গত বছর মার্চ মাসে সাজা স্থগিত করে খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করার ব্যবস্থা করে সরকার। ফলে শারীরিক অবস্থা খারাপের দিকে গেলে খালেদা জিয়ার ব্যাপারে সরকার নমনীয় হবে বলেই মনে করে বিএনপি।

সরকারই করণীয় ঠিক করবে : অ্যাটর্নি জেনারেল

রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে। তবে এখন বিদেশ নিতে হলে তাঁকে আদালতে আসতে হবে বলে আমার মনে হচ্ছে। তার পরও বিষয়টি ভালোভাবে না দেখে এই মুহূর্তে বলতে পারছি না।’ খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে গতকাল এই অভিমত দেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

তিনি আরো বলেন, ‘উনার (খালেদা জিয়া) চিকিৎসা কতটুকু প্রয়োজন, বাংলাদেশেই তাঁর চিকিৎসা সম্ভব কি না, বাংলাদেশে কী ব্যবস্থা আছে—সব কিছু দেখেই সরকার বিবেচনা করবে। সরকার যদি প্রয়োজন মনে করে, আর আইন অনুযায়ী প্রয়োজন হয় যে আদালতে যেতে হবে, তবে আদালতে আসতে হবে। যেখানে প্রয়োজন সেখানেই সরকার আসবে। সরকারই ঠিক করবে প্রয়োজন আছে কি না। কারণ এটা সরকারি আদেশ। পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারই করণীয় নির্ধারণ করবে।’