বিগত দশকজুড়ে বিশ্বে উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়েছে। এক মার্কিন মুল্লুকেই প্রায় চার কোটি নতুন উদ্যোক্তা এ দশকে আবির্ভূত হয়েছেন। এমনকি করোনা মহামারিকালে ২০২০ সালে সেখানে নতুন করে এমপ্লয়ার আইডির জন্য আবেদনের সংখ্যা ২০১৯-এর চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি হয়েছে। এর দুটো কারণ। প্রথমত অনেকেই এখন নিজের ‘বস’ নিজে হতে চায়। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ও ইন্টারনেটের বিস্তৃতি নিজে কিছু করাকে সহজ করে দিয়েছে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র আট লাখ। তাঁদের মধ্যে ৯৬ হাজার ফেসবুক ব্যবহার করতেন। এখন দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা সাড়ে ১১ কোটি, যার চার কোটির বেশি ফেসবুক ব্যবহার করেন। দশকজুড়ে দেশে আউটসোর্সিং পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তির সংখ্যাও অনেক বেড়ে ছয় লাখের বেশি হয়েছে। তাঁদের বেশির ভাগই গ্লোবাল মার্কেটপ্লেসগুলোতে কাজ করেন। কেউ কেউ নিজে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদেরও কাজের সুযোগ করে দিয়েছেন।
প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় ২২ লাখ ছেলেমেয়ে কর্মবাজারে আসে। তাদের অর্ধেকও নিজের জন্য একটি শোভন কাজ নিশ্চিত করতে পারে না। এই সমীকরণের একটি প্রতিষ্ঠিত সমাধান হলো কর্মপ্রত্যাশীদের একটি অংশকে উদ্যোক্তায় পরিণত করা। সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করা, তথ্যপ্রযুক্তির সুফল তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াসহ নানাবিধ উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটা আমরা করব, তত তাড়াতাড়ি আমরা কর্মসংস্থানের সমীকরণ সমাধানের দিকে এগোব
এ এগিয়ে চলার মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পাইকারি ও খুচরা বিক্রি প্রতিষ্ঠানের শুমারির ফল দেখে হোঁচট খেয়েছি। দেখা যাচ্ছে, ২০০৯-২০১০ সালে দেশে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ৫০ হাজার ১২৩। ২০১৯-২০২০ সালে সেটি কমে হয়েছে ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭। অর্থাৎ মোট ১ লাখ ৯ হাজার ২২৬টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ১০ বছরে এ খাতে কর্মসংস্থান কিন্তু প্রত্যাশিতভাবেই বেড়েছে। এ খাতে এখন কর্মীর সংখ্যা ১ কোটি ৪১ লাখ ৪ হাজার ৭৫৩। অর্থাৎ ১০ বছর আগে যেখানে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গড়ে দুজন কর্মী ছিলেন, সেখানে এখন তা গড়ে সাড়ে পাঁচজনে উন্নীত হয়েছে। সেই হিসাবে ২০০৯-২০১০ সালের সব প্রতিষ্ঠানকেই যদি আমরা ধরে রাখতে পারতাম, তাহলে আরও ছয় লাখ লোকের কর্মসংস্থান হতো!
প্রশ্ন হচ্ছে বিশ্বে যেখানে উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে, সেখানে দেশে এ খাতে কেন উদ্যোক্তার সংখ্যা কমে গেছে! এখন দেশেও বিভিন্ন উদ্যোগের রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। চালু রয়েছে উদ্যোক্তা তৈরির আয়োজন, যার মাধ্যমে হবু উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ, মেন্টরিং, এমনকি অনুদানও দেওয়া হয়। কেবল তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের একটি বিশেষ প্রকল্পও আছে। সরকারি মালিকানায় স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি ভেঞ্জার বিনিয়োগ কোম্পানি গঠিত হয়েছে, যা এরই মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানে ১৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। চালু হয়েছে বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্ট, যেখানে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচিত উদ্যোক্তাদের প্রয়োজনীয় আর্থিক অনুদান দেওয়া হবে। শুধু সরকারি উদ্যোগ নয়। এরই মধ্যে দেশে বেসরকারি ভেঞ্চার বিনিয়োগের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার পাশাপাশি বিভিন্ন উদ্যোগে ব্যক্তিগতভাবে বিনিয়োগ (এনজেল বিনিয়োগকারী) করতে আগ্রহীদের নেটওয়ার্কও গড়ে উঠেছে। গত কিছুদিনের মধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ বিদেশি বিনিয়োগও জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছে।বিজ্ঞাপন
এ জন্য বিবিএসের জরিপের ফলাফল আমাদের নিবিড় মনোযোগ দাবি করে। কারণ বোঝা যাচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের একটি খাতে লক্ষাধিক উদ্যোক্তা ঝরে পড়েছেন। ‘চাকরি খুঁজব না চাকরি দেব’ নামের তরুণ উদ্যোক্তাদের একটি প্ল্যাটফর্মের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে উদ্যোক্তানির্ভর একটি ইকোসিস্টেম এখনো প্রত্যাশিত মানে পৌঁছাতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে ব্যবসা শুরুর প্রথম দলিল তথা ট্রেড লাইসেন্সের কথা বলা যায়। এখন যে কেউ বাড়িতে বসে স্মার্টফোনের মাধ্যমে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট, বিকাশের অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। সেটা ব্যবহার করে তিনি অনলাইনে কেনাকাটা করতে পারেন, ইউটিলিটির বিল পরিশোধ করতে পারেন। কিন্তু একই পদ্ধতিতে সারা দেশের তরুণেরা নিজেদের ট্রেড লাইসেন্স করতে পারেন না। এ জন্য তাঁকে একটি ঘর ভাড়ার চুক্তিপত্র জমা দিতে হয়। অথচ বাসায় বসে জামাকাপড় তৈরি করে ফেসবুকে একটি পেজ খুলে একটি মেয়ে সহজে নিজের উদ্যোগ শুরু করতে পারে। এ জন্য তার যেমন কোনো আলাদা ঘর ভাড়া করতে হয় না, তেমনি যারা তার কাছ থেকে জামা কিনছে, তারাও তার শোরুম বা অফিসের খোঁজ করছে না। তথ্যপ্রযুক্তি এ বিশাল সুবিধাটি তরুণদের সামনে উন্মোচন করেছে। এসব তরুণ উদ্যোক্তার ল্যাপটপই তাঁর অফিস।
হোঁচট খেয়ে ব্যবসা শুরু করার পর আমাদের উদ্যোক্তারা দ্বিতীয় হোঁচট খান যখন ব্যাংক বা কোনো অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়। যেহেতু তাদের কোনো ‘স্থায়ী’ সম্পদ থাকে না, কাজেই এ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ঋণ দিতে আগ্রহ দেখায় না। কিন্তু এই একুশ শতকে একটি প্রতিষ্ঠানের বেড়ে ওঠার সঙ্গে তার স্থায়ী সম্পদ তথা জমি, মেশিন বা চেয়ার–টেবিলের তুলনায় মেধাসম্পদেরই জোর বেশি। দেশে কল সেন্টার প্রতিষ্ঠার সামনের সারির উদ্যোক্তা আহমেদুল হকের ভাষ্যে, ‘কল সেন্টারের অ্যাসেট রাতের বেলা ঘুমানোর জন্য নিজের বাড়িতে চলে যায়।’ এ রকম অ্যাসেটের বিপরীতে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ আমরা দেখি না।
আবার বিডা প্রতিষ্ঠার পর কয়েক বছর চলে যাওয়ার পরও বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্সে আমরা তলানিতে পড়ে আছি। ১৯০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৬৮তম। এ অঞ্চলে আমাদের নিচে আছে কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান। এ কারণে দেশের অনেক স্টার্টআপ সিঙ্গাপুরেও তাদের প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করছে। তলিয়ে দেখলে এ রকম আরও অনেকগুলো কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
প্রতিবছর আমাদের দেশে প্রায় ২২ লাখ ছেলেমেয়ে কর্মবাজারে আসে। তাদের অর্ধেকও নিজের জন্য একটি শোভন কাজ নিশ্চিত করতে পারে না। এই সমীকরণের একটি প্রতিষ্ঠিত সমাধান হলো কর্মপ্রত্যাশীদের একটি অংশকে উদ্যোক্তায় পরিণত করা। সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত করা, তথ্যপ্রযুক্তির সুফল তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়াসহ নানাবিধ উদ্যোগ আমাদের নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটা আমরা করব, তত তাড়াতাড়ি আমরা কর্মসংস্থানের সমীকরণ সমাধানের দিকে এগোব।