একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা কোরবানি করে থাকি। এ জন্য পশু ক্রয় করা থেকে শুরু করে অনেকগুলো কাজ রয়েছে, যার মাধ্যমে সম্পন্ন হয় কোরবানি। এগুলোর মধ্যে পশু জবেহ করা হলো অন্যতম। এর উপরই নির্ভর করছে কোরবানি ঠিকভাবে হচ্ছে কি হচ্ছে না। যেগুলো সাধারণত আমরা অনেকেই জানি না।
কোরবানির পশু কিভাবে জবেহ করতে হবে এবং এ সময় কি কি করা যাবে তা নিয়ে মাওলানা মনযূরুল হক বলেন-
কোরবানিদাতা নিজের কোরবানির পশু নিজেই জবেহ করবেন, যদি তিনি ভালোভাবে জবেহ করতে পারেন তবেই। কেননা, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে জবেহ করেছেন। আর জবেহ করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের একটি মাধ্যম । তাই প্রত্যেকের উচিত নিজের কোরবানির পশু নিজে জবেহ করা।
ইমাম বুখারি (রাহ.) বলেছেন, সাহাবি আবু মুসা আশআরী (রা.) নিজের মেয়েদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা যেন নিজ হাতে নিজেদের কোরবানির পশু জবেহ করেন। (ফাতহুল বারী, ১০/১৯) তার এ নির্দেশ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মেয়েরা কোরবানির পশু জবেহ করতে পারেন।
তবে কোরবানির পশু জবেহ করার দায়িত্ব অন্যকে অর্পণ করা জায়েয আছে। কেননা, সহিহ মুসলিমের হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ (সা.) তেষট্টিটি কোরবানির পশু নিজ হাতে জবেহ করে বাকিগুলো জবেহ করা দায়িত্ব আলী [রা.] কে অর্পণ করেছেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১২১৮)।
জবেহ করার সময় যেসব বিষয় লক্ষণীয়, তা হলো- পশুর প্রতি দয়া করা ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করা। আর তা নিম্নরূপে সম্ভব:
১. এমন ব্যবস্থা নিয়ে জবেহ করা, যাতে পশুর অধিক কষ্ট না হয় এবং সহজেই প্রাণ ত্যাগ করতে পারে। জবেহ যেন খুব তীক্ষ্ম ধারালো ছুরি দ্বারা সম্পন্ন করা হয়। মূলত পশুর বিনা কষ্টে খুবই শীঘ্রতার সঙ্গে প্রাণ বধ করাই উদ্দেশ্য।
হাদিসে এসেছে- সাহাবী শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) বলেছেন: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সব বিষয়ে সবার সঙ্গে সুন্দর ও কল্যাণকর আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। অতএব, তোমরা যখন হত্যা করবে তখন সুন্দরভাবে করবে আর যখন জবেহ করবে তখনও তা সুন্দরভাবে করবে। তোমাদের একজন যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং যা জবেহ করা হবে তাকে যেন প্রশান্তি দেয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৯৫৫)
বধ্য পশুর সম্মুখেই ছুরি শান দেওয়া উচিত নয় (মাকরূহ)। যেহেতু নবী করীম (সা.) ছুরি শান দিতে এবং তা পশু থেকে গোপন করতে আদেশ করেছেন এবং বলছেন যখন তোমাদের কেউ জবেহ করবে, তখন সে যেন তাড়াতাড়ি করে। (মুসনাদে আহমদ, ২/১০৮; ইবনু মাজাহ, হাদিস নং ৩১৭২; সহিহ তারগীব, ১/৫২৯)।
আর যেহেতু পশুর চোখের সামনেই ছুরি ধার দেওয়ায় তাকে চকিত করা হয়; যা বাঞ্ছিত অনুগ্রহ ও দয়াশীলতার প্রতিকূল। একইভাবে একটি পশুকে অন্য একটি পশুর সামনে জবেহ করা এবং ছেচরে জবেহ স্থানে টেনে নিয়ে যাওয়াও মাকরূহ।
২. কোরবানির পশু যদি উট হয় ( অথবা এমন কোন পশু হয় যাকে আয়ত্ব করা সম্ভব নয়) তাহলে তাকে বাম পা বাধা অবস্থায় দাঁড় করিয়ে নহর করা হবে। কেননা আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন- সুতরাং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান অবস্থায় তাদের উপর তোমরা আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। [সূরা হজ্জ (২২):৩৬]।
ইবনে আববাস [রা.] বলেন, এর অর্থ হলো তিন পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সামনের বাম পা বাঁধা থাকবে। (তাফসীর ইবনে কাসির)। যদি উট ছাড়া অন্য পশু হয় তাহলে তা বাম কাতে শয়নাবস্থায় জবেহ করা হবে। যেহেতু তা সহজ এবং ডান কাতে ছুরি নিয়ে বাম হাত দ্বারা মাথায় চাপ দিয়ে ধরতে সুবিধা হবে। সম্ভব হলে পশুকে ডান কাতে শুইয়ে জবেহ করার চেষ্টা করতে হবে।
কারণ এ ক্ষেত্রে পশুকে আরাম দেওয়াই উদ্দেশ্যে। পশুর গর্দানের এক প্রান্তে পা রেখে জবেহ করা মুস্তাহাব। যাতে পশুকে অনায়াসে কাবু করা যায়। কিন্তু গর্দানের পিছন দিকে পা মুচড়ে ধরা বৈধ নয়। কারণ তাতে পশু অধিক কষ্ট পায়। যেমন ইতোপূর্বে আনাস (রা.) বর্ণিত বুখারির হাদিসে আলোচনা করা হয়েছে।
৩. জবেহকালে পশুকে কিবলামুখী করে শয়ন করাতে হবে। (আবূ দাউদ, ইবনু মাজাহ, ২/১০৪৩) তবে এ হাদিসটির সনদ নিয়ে সমালোচনা করা হয়েছে। অন্যমুখে শুইয়েও জবেহ করা সিদ্ধ হবে। যেহেতু বিবলামুখ করে শুইয়ে জবেহ করা ওয়াজিব হওয়ার কোন শুদ্ধ প্রমাণ নেই। (আহকামুল উযহিয়্যাহ, পৃ. ৮৮,৯৫)।
৪. জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ বলতে হবে। কারণ এটা বলা ওয়াজিব। আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন: যার উপর আল্লাহর নাম (বিসমিল্লাহ) উচ্চারণ করা হয়েছে তা থেকে তোমরা আহার কর। [সূরা আনআম (৬):১১৮]। এবং যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়নি তা হতে তোমরা আহার কারো না, এটা অবশ্যই পাপ। [সূরা আনআম (৬): ১২১]।
আর নবী করীম (সা.) বলেছেন, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয় তা ভক্ষণ করো। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২৩৫৬; সহিহ মুসলিম , হাদিস নং ১৯৬৮)। জবেহকালীন সময়ে বিসমিল্লাহর সঙ্গে আল্লাহু আকবার যুক্ত করা মুস্তাহাব। অবশ্য এর সঙ্গে কবুল করার দোয়া ছাড়া অন্য কিছু অতিরিক্ত করা বিধেয় নয়। যেমন হাদিসে এসেছে- জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত- একটি দুম্বা আনা হলো। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজ হাতে জবেহ করলেন এবং বললেন, বিসমিল্লাহ ওয়া আল্লাহু আকবর, হে আল্লাহ! এটা আমার পক্ষ থেকে । এবং আমার উম্মতের মাঝে যারা কোরবানি করতে পারেনি তাদের পক্ষ থেকে। (আবু দাউদ)
অন্য হাদিসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ (সা.) দুটি শিংওয়ালা ভেড়া জবেহ করলেন, তখন বিসমিল্লাহ ও আল্লাহু আকবার বললেন। (সুনানে দারামী, হাদিস নং ১৯৮৮; হাদিসটি সহিহ)। জবেহ করার সময় বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবর পাঠের পর – ‘হে আল্লাহ এটা তোমার তরফ থেকে তোমারই জন্য’ বলা যেতে পারে।
যার পক্ষ থেকে কোরবানি করা হচ্ছে তার নাম উল্লেখ করে দোয়া করা জায়েয আছে। এ ভাবে বলা যায়, হে আল্লাহ তুমি অমুকের পক্ষ থেকে কবুল করে নাও। যেমন হাদিসে এসেছে আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরবানির দুম্বা জবেহ করার সময় বললেন- আল্লাহর নামে, হে আল্লাহ! আপনি মোহাম্মদ ও তার পরিবার-পরিজন এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করে নিন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১৯৬৭)।
পশু জবেহ করার সময় নবী করীম (সা.) এর উপর দরূদ পাঠ করা বিধেয় নয়, বরং তা বিদআত। (আল-মুমতে, ৭/৪৯২) যে বিসমিল্লাহর সঙ্গে আর-রাহমানির রাহীম যোগ করাও সুন্নাত নয়। যেহেতু এ সম্বন্ধে কোন দলিল নেই।
জবেহের ঠিক পূর্বে বিসমিল্লাহ পাঠ জরুরি। এরপর যদি লম্বা ব্যবধান পড়ে যায়, তাহলে পুনরায় তা ফিরিয়ে বলতে হবে। তবে ছুরি ইত্যাদি হাতে নিয়ে প্রস্তুতি নেওয়ায় যেটুকু ব্যবধান পড়ে তাতে বিসমিল্লাহ পড়ে অপর পশু জবেহ বৈধ নয়। বরং অন্য পশুর জন্য পুনরায় বিসমিল্লাহ পরা জরুরি। অবশ্য বিসমিল্লাহ বলার পর অস্ত্র পরিবর্তন করাতে আর পুনবায় পড়তে হয় না। উল্লেখ্য যে, পশু জবেহর পর পঠনীয় কোন দোয়া নেই।
৫. জবেহতে রক্ত প্রবাহিত হওয়া জরুরি। আর তা দুই শাহরগ (কণ্ঠনালীর দু’পাশে দুটি মোটা আকারের শিরা) কাটলে অধিকরূপে সম্ভব হয়। প্রিয় নবী করীম (সা.) বলেন, যা রক্ত প্রবাহিত করে, যাতে আল্লাহর নাম নেওয়া হয়, তা তোমরা খাও। তবে যেন (জবেহ করার অস্ত্র) দাঁত বা নখ না হয়। (আহমাদ, বুখারি, মুসলিম প্রভৃতি, সহীহুল জামে, হাদিস নং ৫৫৬৫) সুতরাং রক্ত প্রবাহিত ও শুদ্ধ জবেহ হওয়ার জন্য চারটি অঙ্গ কাটা জরুরি। শ্বাসনালী, খাদ্যনালী এবং পার্শ্বস্থ দুটি মোটা শিরা।
৬. প্রাণ ত্যাগ করার পূর্বে পশুর অন্য কোন অঙ্গ কেটে কষ্ট দেওয়া হারাম। যেমন- ঘাড় মটকানো, পায়ের শিরা কাটা, চামড়া ছাড়ানো ইত্যাদি কাজ জান যাওয়ার আগে বৈধ নয়। একইভাবে, দেহ আড়ষ্ট হয়ে এলে চামড়া ছাড়াতে শুরু করার পর যদি পুনরায় লাফিয়ে ওঠে, তাহলে আরও কিছুক্ষণ প্রাণ ত্যাগ করার জন্য পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যেহেতু পশুকে কষ্ট দেয়া আদৌ বৈধ নয়।
পশু পালিয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ঘাড় মটকানো যাবে না। বরং তার বদলে কিছুক্ষণ ধরে রাখা অথবা চেপে রাখা যায়। জবেহ করার সময় পশুর মাথা যাতে বিচ্ছিন্ন না হয় তার খেয়াল করা উচিত। তা সত্ত্বেও যদি কেটে বিচ্ছিন্ন হয়েই যায়, তাহলে তা হালাল হওয়ার ব্যাপাবে কোন সন্দেহ নেই। জবাই ছেড়ে দেওয়ার পর (অসম্পূর্ণ হওয়ার ফলে) কোনো পশু উঠে পালিয়ে গেলে তাকে ধরে পুনরায় জবাই করা যায়। নইলে কিছু পরেই সে এমনিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। আর তা হালাল।
প্রকাশ থাকে যে, জবেহ করার জন্য পবিত্রতা বা জবেহকারীকে পুরুষ হওয়া শর্ত নয়। যেমন-মাথায় টুপী রাখা বা মাথা ঢাকাও বিধিবদ্ধ নয়। অবশ্য বিশ্বাস ও ঈমানের পবিত্রতা জরুরি। সুতরাং কাফির, মুশরিক ও বেনামাজীর হাতে জবেহ শুদ্ধ নয়।
জবেহ করার আগে কোরবানির পশুকে গোসল দেওয়া, তার খুর ও শিঙে তেল দেওয়া অথবা তার অন্য কোন প্রকার তোয়াজ করা বিদআত।
উল্লেখ্য, জবেহকৃত পশুর রক্ত হারাম। অতএব তা কোন ফল লাভের উদ্দেশ্যে পায়ে মাখা, দেয়ালে ছাপ দেওয়া বা তা নিয়ে ছুড়াছুড়ি করে খেলা করাও বৈধ নয়।