খবরের কাগজ হাতে ওঠার আগেই আজ উচ্ছ্বাস আর শোকে ভাসবে পুরো দেশ! ইংল্যান্ড প্রথমবার ইউরোপসেরা হবে নাকি পুরনো স্বাদটা নতুন করে নেবে ইতালি? সঙ্গে বোনাস হিসেবে থাকছে ওয়েম্বলির উত্তাল গ্যালারি। করোনাকালে খেলোয়াড় তো বটেই, টিভি দর্শকদেরও রোমাঞ্চিত করছে গ্যালারিতে দর্শকদের উচ্চগ্রাম উপস্থিতি।
মর্যাদার একেকটি টুর্নামেন্ট যায় আর দীর্ঘশ্বাস বাড়ে ইংল্যান্ডের। ব্যর্থ হয় ‘ফুটবল ঘরে ফেরার’ অভিযান। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের পর আরো একটা সুযোগ আজ। ওয়েম্বলিতে ইউরোর ফাইনালে ইতালিকে হারালেই প্রথমবার ইউরো জিতবে ইংল্যান্ড। আর ৫৫ বছর পর ‘হোমে’ ফিরবে ফুটবল। ইতালিই বা ছেড়ে দেবে কেন? ইংল্যান্ড ফুটবলের ‘হোম’ হলে রোম তো ‘আঁতুড়ঘর’। তাই ইতালিয়ান সমর্থকদের স্লোগান ‘ফুটবল হোম নয় ফিরবে রোমে’। বিশ্বকাপের চারবারের চ্যাম্পিয়ন হলেও ১৯৬৮ সালের পর জেতা হয়নি ইউরো। ইতালির ৫৩ বছরের হাহাকার মিটবে কি আজ?
ইংল্যান্ডের আদুরে নাম ‘থ্রি লায়ন্স’। ফাইনালে ওয়েম্বলি হয়ে যাচ্ছে আবার সিংহের ডেরা। ৬০ হাজার দর্শক গলা ফাটাবেন হ্যারি কেইন, রহিম স্টার্লিংদের হয়ে। আবেগের বাড়াবাড়িতে সেমিফাইনালে ডেনমার্কের জাতীয় সংগীতের সময় দুয়ো দিয়েছেন কিছু সমর্থক। ফাইনালে এমন কিছুর পুনরাবৃত্তি যে লজ্জার হবে স্মরণ করিয়ে দিলেন ইংলিশ কিংবদন্তি ও ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা গ্যারি লিনেকার, ‘প্রতিপক্ষের জাতীয় সংগীতকে শ্রদ্ধা করা উচিত। যারা ব্যঙ্গ করেন তাদের কোনো জাত নেই।’
ফাইনালের আগে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে ইতালিয়ান মিডিয়াও। তাদের শঙ্কা ইংল্যান্ডকে শিরোপা জেতাতে ষড়যন্ত্র করছে উয়েফা! তা না হলে ডেনমার্কের বিপক্ষে শেষ বেলায় বিতর্কিত পেনাল্টি দেওয়া হতো না তাদের। উয়েফা অবশ্য সেই ম্যাচে আতশবাজি পোড়ানো, ড্যানিশ গোলরক্ষকের মুখে লেজার রশ্মির ব্যবহার, জাতীয় সংগীতের সময় দুয়ো দেওয়ার তিনটি অভিযোগ তদন্ত করে শাস্তিও দিয়েছে ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনকে। মাঠের বাইরের এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর উপায় নেই খেলোয়াড়দের। রহিম স্টার্লিং, হ্যারি কেইনদের আটকানোর ছক তাই কষছেন ইতালিয়ানরা। রক্ষণের স্তম্ভ জর্জিও কিয়েল্লিনি জানালেন, ‘কঠিন দ্বৈরথ হতে চলেছে। কেইন খুব ভয়ংকর স্ট্রাইকার। ২০১৫ সালে তুরিনে খেলেছি ওর বিপক্ষে। ওদের সমীহ করছি তবে ভয় পাওয়ার কিছু দেখছি না।’
১৯৬৮ সালে ইউরো জয়ের পর ২০০০ ও ২০১২ সালে ফাইনালে খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল ইতালিকে। ২০০০ সালে ফ্রান্স আর ২০১২-তে তাদের হারায় স্পেন। এবার ইংল্যান্ডের কাছে এমন বেদনায় নীল হতে চায় না তারা। বরং করতে চায় নীল উৎসব।
ইউরোর গ্রুপ পর্বে বিবর্ণ ছিলেন কেইন। তবে নক আউটে রহিম স্টার্লিংয়ের সঙ্গে তাঁর জুটিই পথ দেখিয়েছে ইংলিশদের। ৪ গোল করে গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে এখন কেইন। গত বিশ্বকাপেও ৬ গোল করে জিতেছিলেন গোল্ডেন বুট। সেবার পুড়তে হয়েছিল শিরোপা জিততে না পারার বেদনায়। ইউরোয় এমন কিছুর পুনরাবৃত্তি চান না ইংলিশ অধিনায়ক, ‘ওয়েম্বলিতে ফাইনাল খেলাটা বিশেষ কিছু। দেশের দর্শকদের সামনে রোমাঞ্চকর কিছু করতে মুখিয়ে আমরা। ১৯৬৬ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জিতেছিল ওয়েম্বলিতেই। একই ভেন্যুতে নতুন ইতিহাস গড়তে চাই এবার। ওরা অনেক শিরোপা জিতেছে বলে এগিয়ে থাকবে না, দুই দলের সুযোগই ৫০-৫০।’
গ্যারেথ সাউথগেট দায়িত্ব নিয়ে বদলে দিয়েছেন দলটা। তাঁর হাত ধরে গত বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছেছিল ইংল্যান্ড। প্রথমবার টিকিট পেয়েছে ইউরো ফাইনালের। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও প্রশংসায় ভাসালেন তাঁকে, ‘জাতীয় দল নিয়ে সাউথগেট দারুণ কাজ করেছেন। ওকে সম্মান জানাই।’ ইউরো জিতলে সাউথগেটকে নাইটহুড দেওয়া হবে বলেও গুঞ্জন ইংলিশ মিডিয়ায়। পরিকল্পনা হয়ে গেছে, ইংল্যান্ড চ্যাম্পিয়ন হলে সোমবার দেশটিতে থাকবে সরকারি ছুটি। আর শিরোপা জয়ের টাকা দান করা হবে করোনাযুদ্ধে সামনের সারিতে থেকে লড়াই করা চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীদের।
সাউথগেট যেমন ইংল্যান্ডকে বদলে দিয়েছেন, তেমনি ইতালিয়ান ফুটবলের দর্শন পাল্টে ফেলেছেন রবার্তো মানচিনি। চিরকালীন রক্ষণাত্মক ‘কাতান্নেচিও’র বদলে ইতালি খেলছে আক্রমণাত্মক ফুটবল। গোলও করেছে ১২টি, যা মর্যাদার কোনো টুর্নামেন্টে তাদের সর্বোচ্চ। একসময় মানচিনি বলেছিলেন, ‘দেশের হয়ে তাদেরই খেলা উচিত যাদের জন্ম শুধু ইতালিতে।’ সেখান থেকে সরে এসেছেন ইতালিয়ান কোচ। তাই একাদশে এখন ব্রাজিলে জন্ম নেওয়া দুজন জর্জিনহো ও এমারসন। চেলসির হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা জর্জিনহোর জাতীয় দলে আদুরে নাম ‘প্রফেসর’। স্পেনের বিপক্ষে সেমিফাইনালে ঠাণ্ডা মাথায় শেষ টাইব্রেকার শটটা জালে জড়িয়েছিলেন তিনিই। ইতালির বলের বেশি দখল রেখে খেলার অন্যতম কারিগরও তিনি। ফাইনালেও মাঝমাঠের প্রাণ হয়ে থাকতে চান জর্জিনহো, ‘ব্রাজিলের জন্য আমার মন কাঁদে না। সব স্বপ্ন ইতালিকে ঘিরে। দলকে শিরোপা জেতাতে নিজের সর্বোচ্চটাই করব আমি।’
১৯৬৮ সালের ইউরোর পাশাপাশি ১৯৮২ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন দিনো জফ। ইতালিয়ান এই কিংবদন্তি গোলরক্ষক মুগ্ধ মানচিনির দলের পারফরম্যান্সে, ‘আমাদের ১৯৮২ সালের দলটার কথাই মনে করাচ্ছে মানচিনির এই ইতালি। দুটো দলই অনেক গতিনির্ভর আর মুখিয়ে থাকে গোলের জন্য।’ হ্যারি কেইন আর একবার লক্ষ্যভেদ করলেই ছাড়িয়ে যাবেন মর্যাদার টুর্নামেন্টে গ্যারি লিনেকারের ১০ গোলের কীর্তি। কেইনকে আগাম শুভেচ্ছাও জানিয়ে রাখলেন লিনেকার, ‘কেইনের জন্য শুভ কামনা সব সময়। পুরো ইংল্যান্ড তাকিয়ে ওর দিকে।’ সাবেক অধিনায়ক অ্যালান শিয়েরারের মতে, ইউরোর শিরোপা আর গোল্ডেন বুট ইংলিশ ফুটবলে অমর করে দিতে পারে কেইনকে। তেমনি চিরস্মরণীয় হতে পারেন রহিম স্টার্লিংও। ৩ গোল ও ১ অ্যাসিস্টে টুর্নামেন্টসেরা হওয়ার অন্যতম দাবিদার এই তরুণ।
ফাইনালে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাবেন না দুই কোচ। নিজের প্রিয় ৪-৩-২-১ ছকে ইংল্যান্ডকে খেলাবেন সাউথগেট। ফিল ফোডেন গতকাল অনুশীলন করতে না পারলেও উদ্বিগ্ন নন ইংলিশরা, কারণ প্রথম একাদশেই থাকেন না তিনি। জ্যাডন সাঞ্চো, জ্যাক গ্রিয়েলিশও থাকবেন বেঞ্চে। কেইনের পেছনে স্টার্লিং, মাউন্ট আর সাকাকেই পছন্দ সাউথগেটের। ইতালিয়ান কোচ মানচিনি ৪-৩-৩ ছকে সামনে রাখবেন কিয়েসা, ইম্মোবিলে আর ইনসিনিয়েকে। জর্জিনহো, বারেল্লা আর ভেরাত্তিরা মাঝমাঠের প্রাণ। রক্ষণে বোনুচ্চি ও কিয়েল্লিনির সম্মিলিত বয়স ৭০ হলেও, ইংলিশ আক্রমণের ঢেউ রুখে দেওয়ার সামর্থ্য ভালোই আছে দুজনের। ইংল্যান্ড অতি আক্রমণাত্মক খেললে পাল্টা আক্রমণে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন ইম্মোবিলে, ইনসিনিয়েনেরা।
শেষ পর্যন্ত সেরাদের নিয়ে সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে প্রস্তুত দুই দল। একটা শিরোপার জন্য বুভুক্ষু হয়ে আছে তারা। এ জন্য অপেক্ষা আর মাত্র ৯০ মিনিটের। নাকি অতিরিক্ত সময় গড়িয়ে আনন্দ-বেদনার কাব্য রচিত হবে টাইব্রেকারে?