নির্ধারিত নতুন ভাড়ার চেয়েও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়েছে বাস ও লঞ্চে। গতকাল সোমবার বাসভাড়া বাড়ার প্রথম দিন রাজধানীর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পথে ঘুরে এমন চিত্র দেখা যায়। দূরপাল্লার বাসেও নেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া। লঞ্চেও একই চিত্র দেখা গেছে।
গতকাল যাত্রীবাহী নৌযানের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। লঞ্চের ভাড়া বাড়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বরিশালের লঞ্চঘাটে। বরিশালে লঞ্চে ২০০ টাকার ভাড়া ৩৫০ টাকাও নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম নগরের বেশির ভাগ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (সিএনজি) চালিত গণপরিবহনেও নতুন বর্ধিত ভাড়া আদায় করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গণহারে সব গণপরিবহনে বেড়েছে বাসের ভাড়া। প্রতি কিলোমিটারে ২.১৫ টাকা নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হলেও এই ভাড়া কেউ মানছে না। প্রায় সব পথেই অন্তত প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া নেওয়া হয়েছে ২.৫০ টাকা করে। এমনকি অনেক পথে কোনো ধরনের হিসাব ছাড়া ২০ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা, ২৫ টাকার ভাড়া ৪০ টাকা আদায় করা হয়েছে।
রাইদা বাসে নিয়মিত চলাচলে করেন সাদ্দাম হোসেন। মালিবাগের আবুল হোটেলের কিছুটা আগে থেকে বাসে উঠে যমুনা ফিউচার পার্কে নামেন। এখানেই তাঁর অফিস। এর আগে তাঁকে ২০ টাকা ভাড়া দিতে হলেও গতকাল দিয়েছেন ৩০ টাকা। তিনি বলেন, ‘কোনো ধরনের হিসাব ছাড়া বাসের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে।’
ভাড়া বাড়ার বাড়াবাড়ি নিয়ে গতকাল বাসে যাত্রী ও চালকের সহযোগীর মধ্যে বাগবিতণ্ডাও কম হয়নি। যাত্রীরা যেমন নতুন নির্ধারিত ভাড়ার বেশি দিতে রাজি নয়, তেমনি সহযোগী তাঁর মালিকের বলে দেওয়া ভাড়ার চেয়ে কম নেবেন না। এমন পরিস্থিতিতেই বাগবিতণ্ডা চলমান ছিল সারা দিন।
আগারগাঁও থেকে ফার্মগেটের ভাড়া ছিল পাঁচ টাকা। যাত্রী পাঁচ টাকা দিতে চাইলে চালকের সহযোগী জানান, ১০ টাকা দিতে হবে। যাত্রী ১০ টাকার সঙ্গে তাঁকে কিছু কথা শুনিয়ে বাস থেকে নেমে যান।
ওই বাসের চালক রমিজউদ্দিন বলেন, ‘যাত্রী ও আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বর্ধিত ভাড়ার লাভ যায় মালিকের কাছে। লাভে আমার কোনো অংশ নেই। দিনশেষে পারিশ্রমিক আগেও যা ছিল, এখনো তা-ই। আর ওই যাত্রী একটু খিস্তিখেউড় করে মনে শান্তি পায়, মনের যন্ত্রণা মেটায়। এ জন্য আমরা নীরব থাকি। গণ্ডগোল করি না।’
গতকাল সকালে মোহাম্মদপুর বসিলা থেকে উত্তরার কামারপাড়া পথে প্রজাপতি ও পরিস্থান পরিবহন ৬৫ টাকা করে ভাড়া নিয়েছে বলে অভিযোগ করলেন শফিকুল ইসলাম নামের এক যাত্রী। এই পথে আগের ভাড়া ছিল ৪০ টাকা। কিলোমিটার প্রতি ৪৫ পয়সা ভাড়া বাড়ানো হলেও বর্ধিত ভাড়া ৬৫ টাকা হয় না। তিনি বলেন, ‘ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে।’
রাজধানীর পুরান ঢাকার পোস্তগোলা থেকে এসে থামে বোরাক পরিবহন নামের একটি বাস। এ সময় অপেক্ষমাণ যাত্রীরা উঠতে যায়। কন্ডাক্টর বলতে থাকেন—গুলিস্তান ১৫ টাকা, ১৫ টাকা। যাত্রীরা হুড়মুড় করে উঠে যায়। এরপর বাসটি দোলাইরপাড় এলাকায় যাওয়ার পর কন্ডাক্টর ভাড়া নিতে যান। পোস্তগোলা থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত আগের ভাড়া ছিল ১০ টাকা। পাঁচ টাকা ভাড়া বাড়ানোর কারণে অনেকেই ক্ষিপ্ত হয়। আবদুল মজিদ নামের এক ব্যবসায়ী কন্ডাক্টরের কাছে জানতে চান, কত পার্সেন্ট বাসভাড়া বেড়েছে। যা বেড়েছে তাতে করে দুই টাকা বাড়তে পারে। কিন্তু তাঁর কথায় কোনো কাজ হয়নি। নাছোড়বান্দা কন্ডাক্টর ১৫ টাকা করেই ভাড়া আদায় করেন।
ঢাকায় ৫ টাকা ভাড়ার অবসান : ধর্মঘটের আগে পাঁচ টাকা ভাড়ায় রাজধানীর কোনো না কোনো স্থানে যাওয়া যেত। এবার পাঁচ টাকার ভাড়া ১০ টাকা হয়ে গেল। গতকাল নগর পরিবহনের একাধিক শ্রমিককে বলতে শোনা গেছে, এখন পাঁচ টাকায় বাসে ওঠা যাবে না। যত কম দূরত্বেই যান, কমপক্ষে ১০ টাকা দিতে হবে।
তেল না গ্যাস : রাজধানীর প্রতিটি বাসের যাত্রীর মুখে মুখে গতকাল একটি কথাই ছিল—‘তেল না গ্যাস’। বাস শ্রমিকরাও এমন প্রশ্নবাণে জর্জরিত। তবে বাস গ্যাসে চলে—এমন জবাব কোনো শ্রমিককে দিতে শোনা যায়নি।
দূরপাল্লার বাসের টিকিট কাউন্টারে দালালচক্র : ঢাকা-সিলেট রুটে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে দেখা গেছে। বাড়তি ভাড়া নেওয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে দালালচক্র। ফাহিম এন্টারপ্রাইজের সামনে দেখা মেলে এমন এক দালালের। সিলেটের এক যাত্রীকে বাসে উঠিয়ে বাসের সহযোগীর কাছে ৪৫০ টাকা দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন সাহাবুদ্দিন নামের ওই দালাল। কত টাকা ভাড়া নিয়েছে জানতে চাইলে যাত্রী ইসমাইল হোসাইন বলেন, ‘৫০০ টাকা নিয়েছে। টিকিট এখনো দেয়নি।’
এর আগে বাসটির চালক সোহেল মিয়া ও সহযোগীর সঙ্গে কথা বললে জানান, ঢাকা-সিলেট রুটের ফাহিম এন্টারপ্রাইজের ভাড়া আগে ৪০০ টাকা ছিল। তেলের দাম বাড়ায় ৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া একই পথের বৈশাখী এন্টারপ্রাইজসহ কিছু বাসের ভাড়া ৩৫০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম নগরে গ্যাসে চলা গণপরিবহনেও বর্ধিত ভাড়া আদায় : চট্টগ্রাম নগরের প্রধান সড়কের বহদ্দারহাট থেকে মুরাদপুর দূরত্ব এক কিলোমিটার। হিউম্যান হলারে ওঠানামা ভাড়া পাঁচ টাকা। গ্যাসের দাম বাড়ানো না হলেও গ্যাসে চলা হালকা এই যানে ভাড়া গতকাল আট টাকা নেওয়া হয়েছে। ২ নম্বর রুটের কালুরঘাট থেকে নিউ মার্কেটের মিনিবাসের ভাড়া ১৪ টাকা। রফিক নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ২০ টাকা ভাড়া চাইলে তিনি বলেন, সরকার তো ডিজেলে চলা গাড়ির ভাড়া বাড়িয়েছে। বরিশালে ২০০ টাকার লঞ্চভাড়া ৩৫০ টাকা : ঢাকাগামী এমভি সুরভী-৮ লঞ্চের ডেকের যাত্রী হালিমা বেগম। ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে লঞ্চে করে বানারীপাড়ার গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন। গতকাল ঢাকায় এসেছেন ৩৫০ টাকা ভাড়া দিয়ে। ঢাকাগামী এমভি সুন্দরবন ১১ লঞ্চের কেবিনের যাত্রী সরোয়ার হোসেন জানান, সিঙ্গেল কেবিনের এক হাজার টাকার ভাড়া এক হাজার ৪০০ টাকা নিয়েছে। ঢাকা-বরিশাল পথে ডেকের ২৫০ টাকার ভাড়া হয়েছে ৩৫০ টাকা, ডাবল কেবিন দুই হাজার টাকার টাকার ভাড়া নেওয়া হচ্ছে দুই হাজার ৫০০ টাকা।
পণ্য পরিবহন ধর্মঘট স্থগিত : পণ্য পরিবহন খাতের সব গাড়ির ভাড়া ৩০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, ট্যাংক লরি ও প্রাইম মুভার মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। দ্রুত এই প্রস্তাব আলোচনা করে বর্ধিত ভাড়া নির্ধারণ করা হবে।
এমন সমঝোতায় গতকাল রাতে পণ্য পরিবহন ধর্মঘট স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান। গতকাল রাতে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে বৈঠক শেষে এই সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।
রুস্তম আলী খান বলেন, ‘আমাদের পণ্য পরিবহনের সঙ্গে পোশাক খাতসহ অনেক সংগঠন জড়িত। আজকের (গতকাল) বৈঠকে ওই সব সংগঠনের নেতারা ছিলেন না, তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের সঙ্গে আলোচনার সময় চেয়েছেন। আলোচনা চলমান থাকায় ধর্মঘট স্থগিত করা হয়েছে।’
ধর্মঘট স্থগিত থাকাকালে পরিবহনের ভাড়া কিভাবে নির্ধারণ করা হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপাতত আলোচলার ভিত্তিতে ভাড়া ঠিক করা হবে।’ এ ছাড়া বৈঠকে অন্য দুই দাবির মধ্যে মুক্তারপুর ও বঙ্গবন্ধু সেতুর বর্ধিত টোল প্রত্যাহারের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নামে সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসেন মো. মজুমদার বলেন, ‘আজ (গতকাল) রাত থেকেই সব পণ্য পরিবহনের গাড়ি চলবে। আমাদের পক্ষ থেকে ৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।’
বৈঠকে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।