গত ৯ আগস্ট নতুন অপারেটিং সিস্টেমের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিল হুয়াওয়ে। মাইক্রোকার্নেলনির্ভর এই অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে জানাচ্ছেন ।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েনের কারণে কিছুদিন আগে হুয়াওয়ের অ্যানড্রয়েড ও গুগল সেবা ব্যবহার করার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। পরে অবশ্য সেটিও স্থগিত হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যতে হুয়াওয়ে যে আবার এ ধরনের সমস্যায় পড়বে না, এ কথা কে বলতে পারে! সে কথা মাথায় রেখেই হুয়াওয়ে ঘোষণা করেছে তাদের ব্যাকআপ পরিকল্পনা, নিজস্ব এক অপারেটিং সিস্টেম—যার নাম চীনা ভাষায় হংমেং আর ইংরেজিতে ‘হারমনিওএস’।
অ্যানড্রয়েডও হারমনিওএস
গত মাসে হয়ে যাওয়া হুয়াওয়ে ডেভেলপার সম্মেলনের হারমনিওএস কেমন হবে, তার পুরোটাই তুলে ধরা হয়। অনেকেই ধারণা করেছিল, হুয়াওয়ে সম্ভবত অ্যানড্রয়েডের কোড নিয়ে সেটিকে পরিবর্তন করে অ্যানড্রয়েডেরই আরেকটি সংস্করণ তৈরি করবে, যেমনটি শাওমি বা অপো করেছে। অ্যানড্রয়েড যেহেতু সম্পূর্ণ মুক্ত সফটওয়্যার বা ওপেন সোর্স আর তার কোড জিএনইউ লাইসেন্সের মাধ্যমে প্রকাশিত, তাই যুক্তরাষ্ট্র সরকার চাইলেও সেটি ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে না। তবে গুগলের সেবাগুলো, যেমন—গুগল প্লেস্টোর, ইউটিউব বা গুগল অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের কোনো উপায় তাতে রাখা যাবে না। হুয়াওয়ে ফোনগুলোর চীনা বাজারের সংস্করণে এমনটা বহু আগে থেকেই চলে আসছে।
অথচ হারমনিওএস পুরোটাই সম্পূর্ণ নতুন। অ্যানড্রয়েডের সঙ্গে এটির কোনো মিল নেই, অ্যানড্রয়েডের অ্যাপগুলো তাতে চলার কথাও নয়। এতে নেই লিনাক্স কার্নেলের কোনো ছোঁয়া। তবে অ্যানড্রয়েডের মতোই হারমনিওএসের সোর্সকোড হবে উন্মুক্ত।
আপাতত সিস্টেমটি স্মার্টফোনে ব্যবহারের ব্যাপারেও হুয়াওয়ে কিছু বলা থেকে বিরত থেকেছে, ফলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, খুব দ্রুতই হারমনিওএসসমৃদ্ধ ফোন বাজারে আসছে না।
যেমন হবে হারমনিওএস
অ্যানড্রয়েড বা আইওএসের গঠনশৈলী বলা হয় ‘মনোলিথিক’। একটি মূল কার্নেলের ওপর প্রসেসরের আর্কিটেকচার অনুযায়ী সার্ভিস ও অ্যাপের বুননে তৈরি হয় একটি ওএস। নানাবিধ ডিভাইসে সেগুলো ব্যবহার করা হলেও মূল কার্নেল এবং সার্ভিসগুলো থাকে এক। সে জন্য অ্যানড্রয়েড, অ্যানড্রয়েড ফর থিংস, ওয়্যার ওএস এবং ক্রোম ওএসের বেশির ভাগ অংশ এবং চালচলন একই। অ্যাপলের ক্ষেত্রেও মাক কার্নেলের ওপরই ম্যাক, ওয়াচ, আই এবং আইপ্যাডওএস তৈরি করা হয়েছে।
হারমনিওএস আলাদা। এখানে ব্যবহার করা হবে একটি ক্ষুদ্র মাইক্রোকার্নেল, যার সঙ্গে প্রতিটি ডিভাইসের জন্য আলাদাভাবে সার্ভিস এবং হার্ডওয়্যারের বা সফটওয়্যারের সংযোগ তৈরি করা হবে। ফলাফল—একই কার্নেল অনেক ডিভাইসে ব্যবহার হলেও তাতে অপ্রয়োজনীয় কোড একেবারেই থাকবে না। ডিভাইসের হার্ডওয়্যারের সঙ্গে কার্নেল ও সার্ভিসগুলোর সম্পর্ক হবে আরো অনেক গভীর।
নিরাপত্তাও হবে আরো অনেক বেশি, কারণ মাইক্রোকার্নেলের সঙ্গে মূল সিস্টেমের কোনো সরাসরি যোগাযোগের প্রয়োজনই হবে না, রুট অ্যাকসেস পাওয়ার কোনো উপায় রাখা হবে না।
যেসব ডিভাইসে চলবে
হারমনিওএস শুধু ফোন নয়, স্মার্টওয়াচ, স্পিকার, টিভি, এমনকি ল্যাপটপেও ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছে হুয়াওয়ে। মাইক্রোকার্নেলের ওপর তৈরি হওয়ায়, খুব সহজেই সব ধরনের ডিভাইস ও প্রসেসরের জন্য এটি প্রস্তুত করা যাবে। সেটি হতে পারে টাচস্ক্রিন, হতে পারে কি-বোর্ড-মাউস, আবার হতে পারে কোনো ধরনের ডিসপ্লে ও ইনপুট ছাড়া আইওটি ডিভাইস। সব ধরনের আর্কিটেকচার ও কাজে ব্যবহার করার সুবিধা থাকায় একই অ্যাপ ও সেবা সব ডিভাইসেই চালানো যাবে, গড়ে উঠবে একটি সংগতিসম্পন্ন ডিভাইস ইকোসিস্টেম।
শুরুটা যেভাবে হবে
আপাতত স্মার্টফোন বা ট্যাবলেটে হারমনিওএস ব্যবহারের কোনো পরিকল্পনা নেই হুয়াওয়ের। কেননা হারমনিওএস নিজেদের মনমতো হয়নি এখনো। হারমনিওএস ১.০ সংস্করণে এখনো হারমনিওএস মাইক্রোকার্নেলের পাশাপাশি আছে লিনাক্স কার্নেল এবং হুয়াওয়ের পুরনো প্রজেক্ট লাইটওএস কার্নেল। তবে দ্রুতই হারমনিওএস ২.০ সংস্করণ প্রকাশ করা হবে, সেখানে এগুলো আর থাকবে না। ২০১৭ সাল থেকে হারমনিওএস নিয়ে কাজ শুরু করেছে হুয়াওয়ে। মাত্র দুই বছরে একটি অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে পুরোপুরি দাঁড়িয়ে যাবে, সে আশাও করা যায় না। তবে এ বছর থেকেই হুয়াওয়ের টিভি, স্পিকার, স্মার্টওয়াচের মতো পণ্যে হারমনিওএস দেখা যেতে পারে।
হারমনিওএসকে বারবার ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল’ সিস্টেম হিসেবে অবহিত করেছে হুয়াওয়ে। এতে বোঝা যাচ্ছে, সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য তৈরি ডিভাইসের পাশাপাশি কারখানা এবং অন্যান্য প্রকৌশল কাজেই শুরুতে ব্যবহার করা হবে এটি। ডিসপ্লে ও ইনপুটহীন ইন্টারনেট অব থিংস ডিভাইস, যেমন স্মার্ট লাইট, সিকিউরিটি সিস্টেমেও হারমনিওএস ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। স্মার্টহোম ডিভাইসগুলোতেও দেখা যেতে পারে হারমনিওএস।