সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক নিয়োগ-২০১৮’র ভাইভা ৬ অক্টোবর থেকে শুরু হবে। লিখিত পরীক্ষায় পাস করা ৫৫,২৯৫ জন প্রার্থী ভাইভায় অংশ নেবেন। ভাইভার প্রস্তুতি নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন মুন্সীগঞ্জের ধামদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক সোনিয়া আকতার
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের ভাইভা অন্যান্য চাকরির ভাইভা থেকে অনেকটা আলাদা। প্রার্থীর নিজ জেলা ও উপজেলা থেকে সাধারণত প্রশ্ন করা হয়। এখানে মূলত সহজ প্রশ্নই করা হয়, তার পরও অনেকে পারেন না। কেউ কেউ উত্তর জানা থাকলেও ঘাবড়ে যান, ঠিকঠাক বলতে পারেন না। যদি সত্যিই কোনো প্রশ্নের উত্তর না জানেন, তাহলে হাসিমুখেই বলে দিন, ‘দুঃখিত স্যার।’ মানসিক বল আর আত্মবিশ্বাসের পাশাপাশি ভাইভায় ভালো করার সাধারণ কিছু বিষয় আছে।
ভাইভা বোর্ড
সাধারণত ডিসির নেতৃত্বে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিইও) ও জেলার সরকারি কলেজের একজন অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপককে নিয়ে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি ভাইভা বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডে এর চেয়ে বেশি সদস্যও থাকতে পারেন।
ড্রেস কোড
ভাইভা বোর্ডে আপনার পোশাক, অ্যাপিয়ারেন্স, এক্সপ্রেশন, এটিকেট, ম্যানার—এ বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রার্থীর এসব বিষয় বোর্ডের সদস্যরা খেয়াল করেন। তাই ভাইভার সময় নিজের জন্য উপযুক্ত পোশাক নির্বাচন করুন।
ছেলেদের ড্রেস
শার্ট : সাদা ফুলশার্ট। সাদার ওপর যেকোনো স্ট্রাইপ হলেও চলবে। অন্য রঙের মানানসই শার্টও পরতে পারেন। পকেটে একটি কলম রাখবেন।
প্যান্ট : কালো রঙের ফরমাল প্যান্ট পরুন।
হাতঘড়ি, বেল্ট ও জুতা : চামড়ার ফিতার ফরমাল হাতঘড়ি, জুতা ও প্যান্টের সঙ্গে ম্যাচ করে কালো রঙের চামড়ার বেল্ট পরুন। কালো রঙের, রাবারের সোলযুক্ত ফরমাল শু পরিধান করবেন। টাই পরার প্রয়োজন নেই। যাঁরা পাঞ্জাবি-পাজামা পরতে চান, সাদা রঙের পরতে পারেন। ভাইভার পাঁচ-ছয় দিন আগে চুল কাটিয়ে নিন। ভাইভার দু-এক দিন আগে নখ ছোট করে নিন। ভাইভার আগের দিন বা ভাইভার দিন সকালে শেভ করে নিন।
মেয়েদের ড্রেস
মার্জিত রঙের শাড়ি পরিধান করতে পারেন। তবে শাড়ি যেন অতিমাত্রায় কারুকাজের চকমকে না হয়, সেই দিকটা খেয়াল রাখুন। চাইলে সালোয়ার-কামিজও পরতে পারেন। তবে তা যেন মার্জিত রং ও ডিজাইনের হয়। অর্থাৎ শাড়ি কিংবা সালোয়ার-কামিজ যা-ই পরেন, যেন ম্যাচ হয়। স্বাভাবিক মাপের কানের দুল এবং চেন পরতে পারেন। চুল বেণি করে রাখবেন। পায়ের জুতা শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে ম্যাচ করাতে পারলে ভালো হয়। তবে হাই হিল না পরাই ভালো। হালকা মেকআপ এবং মার্জিত রঙের হালকা লিপস্টিক দিতে পারেন। সঙ্গে কালো কালির কলম রাখুন।
ভাইভার জন্য যা যা পড়বেন বা জেনে রাখবেন
১. আপনার এবং আপনার মা-বাবার নামের অর্থ কী?
২. আপনার নামের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিখ্যাত ব্যক্তির নাম।
৩. আপনার বংশপরিচয় বা নামের সঙ্গে পদবি থাকলে সে সম্পর্কিত কিছু তথ্য।
৪. আপনার গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ইত্যাদির নাম, আদি নাম ও নামকরণের ইতিহাস জেনে রাখুন।
৫. আপনার জেলা বিখ্যাত কেন? জেলার বিখ্যাত স্থান, নদীর নাম, পণ্য, ঐতিহ্য ইত্যাদি জেনে রাখুন।
৬. আপনার জেলার শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে বিখ্যাত ব্যক্তি ও তাঁদের সৃষ্টিকর্ম ও অবদান।
৭. আপনি যে প্রতিষ্ঠান থেকে অনার্স/মাস্টার্স করেছেন, ওই প্রতিষ্ঠানের পুরো নাম, প্রতিষ্ঠাকাল, বর্তমান ভিসি বা প্রিন্সিপালের নাম জেনে নেবেন।
৮. ভাইভার দিনের ইংরেজি, বাংলা ও আরবি তারিখ জেনে যাবেন। বিশেষ দিবস হলে সে সম্পর্কে জেনে যাবেন।
৯. ছোট ছোট ট্রান্সলেশন জিজ্ঞেস করতে পারে। তাই সেগুলো চর্চা করুন।
১০. সাম্প্রতিক বিষয়াবলি এবং বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কয়েকজন কবি সম্পর্কে ধারণা রাখতে পারেন।
১১. নিজের সম্পর্কে বলতে বলা এখন বেশির ভাগ ইন্টারভিউ বোর্ডের একটা কমন প্রশ্ন। তাই বাংলা ও ইংরেজিতে নিজের সম্পর্কে বলার প্র্যাকটিস করুন।
১২. যে বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন, বিষয়ের ওপর স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত হোন।
১৩. মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বিশদ ধারণা গ্রহণ করুন।
১৪. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বর্তমান সরকারের সফলতা ও অর্জন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা গ্রহণ করুন।
১৫. প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কিত কিছু তথ্য—শিক্ষার হার, কতগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, বই দিবস, উপবৃত্তি, মন্ত্রী ও সচিবের নাম ইত্যাদি।
১৬. ভিশন ২০২১, ভিশন ২০৪১, মুজিববর্ষ, মেগাপ্রজেক্টস্, এসডিজি, এমডিজি ইত্যাদি দেখতে পারেন।
সহায়ক বই
১. প্রফেসরস্ প্রাথমিক শিক্ষক ভাইভা সহায়িকা।
২. বিসিএস শর্টকাট (সম্পূর্ণ সিরিজ) ও অ্যাশিউর্যান্স বিসিএস ভাইভা সহায়িকা (মুক্তিযুদ্ধ)।
৩. অনার্স-মাস্টার্সের মেজর সাবজেক্টের বেসিক বই।
৪. ইন্টারনেট।
৫. দৈনিক পত্রিকা, কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ইত্যাদি।
পরীক্ষার দিনের প্রস্তুতি
১. নির্ধারিত সময়ের বেশ আগেই প্রস্তুতি সেরে ফেলতে হবে।
২. যেসব কাগজপত্র বোর্ডের সামনে পেশ করতে হবে সেগুলো, প্রবেশপত্র, সব সার্টিফিকেটের মূল কপি এবং অন্যান্য কাগজপত্র আগেই গুছিয়ে নিতে হবে।
৩. পরিপাটি হয়ে বোর্ডে উপস্থিত হবেন।
৪. নির্দিষ্ট সময়ের অন্তত ৩০ মিনিট আগে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছবেন।
৫. আপনার সিরিয়াল পরে থাকলে যাঁদের ভাইভা হয়ে যাবে, তাঁদের কাছ থেকে ধারণা নিতে পারেন। কোনো বিষয়বস্তু না জানা থাকলে ভাইভার আগ মুহূর্তে বই ঘাঁটাঘাঁটি করবেন না। কারণ আপনার কাছে ওই প্রশ্ন না-ও জানতে চাইতে পারে। তবে অন্য কেউ পারলে তাঁর কাছ থেকে সংক্ষেপে জেনে নিতে পারেন।
ভাইভা বোর্ডে করণীয়
১. ভেতরে ঢোকার অনুমতি নিয়ে একটু সামনে গিয়ে যাঁর যাঁর ধর্মীয় রীতিতে অভিবাদন জানাবেন। তারপর চেয়ারের পাশে দাঁড়াবেন। বসতে বললে ধন্যবাদ দিয়ে বসবেন। খেয়াল রাখবেন—চেয়ারে যেন শব্দ না হয়।
২. যিনি প্রশ্ন করবেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেবেন। কথা বলার সময় অপ্রয়োজনীয় হাত-পা নাড়াবেন না।
৩. উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে অল্প কথায় এবং সঠিক পয়েন্টে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন। অপ্রাসঙ্গিকতা পরিহার করুন।
৪. কথা বলার সময় আঞ্চলিকতা পরিহার করবেন।
৫. ঘাবড়াবেন না, রাগবেন না, তর্ক করবেন না, বেয়াদবি করবেন না।
৬. জানা না থাকলে হাসিমুখে ‘দুঃখিত স্যার’ অথবা ‘জানা নেই স্যার’ বলুন।
৭. নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়—এগুলোতে আপনার দক্ষতা না থাকলে বিনয়ের সঙ্গে বলুন, ‘পারি না স্যার।’ তবে আপনি পারেন—এমন কোনো কিছুর কথাও বিনয়ের সঙ্গেই বলবেন।
৮. আপনার ভাইভা শেষ হলে আপনাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিলে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে চলে আসবেন।
ওপরে বর্ণিত পড়াশোনার পরিধি যাঁদের কাছে পীড়াদায়ক মনে হচ্ছে, তাঁদের উদ্দেশে আমার পরামর্শ—যাঁর যাঁর সাধ্য অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করুন। কারণ আপনি পারবেন না এমন প্রশ্ন খুব কমই জিজ্ঞেস করা হবে। তবে ভাইভায় ভালো করলে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে—এটা একটা ব্যাপার যেহেতু, সেহেতু নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য একটু পরিশ্রম করে পড়ালেখা করাই ভালো।
ভাইভার নম্বর বণ্টন
ভাইভায় ২০ নম্বর। লিখিত পরীক্ষায় ছিল ৮০। ভাইভায় পাস করলে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে আপনি কত পেলেন, তার আলোকে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। ভাইভার ২০ নম্বরের বণ্টন—
* ভাইভা বোর্ডে নিজেকে ঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্য ৫ নম্বর।
* একাডেমিক ফলাফলের ওপর ৫ নম্বর।
* আপনার জ্ঞান (নিজের মেজর সাবজেক্ট ও অন্যান্য বিষয়) যাচাই ৫ নম্বর।
* সহশিক্ষা কার্যক্রমে (নাচ, গান, অভিনয়, কবিতা আবৃত্তি, খেলাধুলা, স্কাউটিং ইত্যাদি) ৫ নম্বর।
উল্লিখিত নম্বর বণ্টনে কিছুটা ব্যতিক্রমও ঘটতে পারে।