-এই তুই সামনে আয়…
-জি ভাই আমি?
-হ্যাঁ হ্যাঁ তুই। কান ধর, নীল ডাউন দে আর এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাক। আজকে সকালে ক্যাম্পাসে তুই আমাকে সালাম দেস নাই। তোর শাস্তি দুই দিন তুই হলের বাইরে থাকবি।
-ভাই, আমি তো আপনাকে সালাম দিয়েছিলাম। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি ভাই।
-চুপ বেয়াদব কোথাকার, মুখে মুখে তর্ক করিস। তোর পরিবার তোকে ম্যানার শেখায়নি কীভাবে সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলতে হয়।
রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিডিয়েট সিনিয়র ও জুনিয়র (নবীন) শিক্ষার্থীদের মিটিং (গেস্ট) রুমের কথাবার্তার একটি অংশ এটি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম ৫-৬ মাস নবীন শিক্ষার্থীদের ‘ম্যানারিজম’ শেখানোর নামে মিটিংয়ে (গেস্ট রুমের) এভাবে চলে নানা উপায়ে র্যাগিং ও শারীরিক নির্যাতন। করা হয় অকথ্য ভাষায় গালাগালি। আর এই মিটিং রুমের নেতৃত্ব দিয়ে আসছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
পিছিয়ে নেই ক্যাম্পাসের ছাত্রীদের দুটি হলও। ছাত্রীদের শেখ হাসিনা হলে সিনিয়রদের র্যাগিং ও নির্যাতনের ফলে নবীন পাঁচ ছাত্রীর অজ্ঞান হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ছাত্র হলেও গভীর রাতে নবীন শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়া, মারধর করা হচ্ছে অহরহ। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তিনটি এবং ছাত্রীদের দুই হলে নিয়মিত র্যাগিং ও শারীরিক নির্যাতন করা বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, ভর্তি হওয়ার পর থেকেই দীর্ঘ ৫ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরেবাংলা হলের গেস্ট রুম, ডাইনিং রুম, নবাব সিরাজ উদ-দৌলা হলে ডাইনিং রুমে, কাজী নজরুল ইসলাম হলের গেস্ট রুম ও ডাইনিং রুমে ম্যানারিজম (আচরণ) শেখানোর জন্য মিটিং করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি বঙ্গ (আঞ্চলিকতা, যেমন উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গ ইত্যাদি) গ্রুপে বিভক্ত এবং প্রত্যেক বঙ্গ নিজ নিজ এলাকার নবীন শিক্ষার্থীদের নিয়ে মিটিং করা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়া ওই বঙ্গের সিনিয়র নেতাদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।
যেখানে নবীন শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। মিটিং (গেস্ট রুম) নেতৃত্বদানকারী সিনিয়রা বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত। তারা ছাত্রলীগের কর্মী বলে নিজেদের দাবি করেন। মিটিং (গেস্ট রুম) চলাকালীন র্যাগিংয়ের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়লেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নির্যাতিত এক ছাত্র বলেন, ভর্তির পরের দিন থেকে আমাদের রাতে মিটিংয়ে ডাকা হতো। ফোন করে গভীর রাতে ১ মিনিটের মধ্যে মিটিংয়ে আসার জন্য বলা হতো, আসতে দেরি হলে কান ধরে উঠবস শাস্তি পেতে হতো। ম্যানারিজম (আচরণ) শেখানোর নামে মিটিং হয় প্রায় প্রতি সপ্তাহেই, কিন্তু যেভাবে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয় তা স্বাভাবিক মস্তিষ্কের কোনো মানুষ গ্রহণ করতে পারবে না। অন্য এক ছাত্র বলেন, প্রথমে আমাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয় এবং মিটিংয়ের এক পর্যায়ে লাইট অফ করে বড় ভাইয়েরা উত্তেজিত হয়ে গায়ে হাত তোলে এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করে।
এ ছাড়া ওই সিনিয়রদের নির্দেশে ক্যাম্পাসে দল বেঁধে প্রত্যেক দিন বিকাল ৫টা থেকে রাত ৭টা পর্যন্ত শোডাউন দিতে হয় এবং পরিচিত ও অপরিচিত যাদের সঙ্গে দেখা হয় তাদের সালাম ও কুশল বিনিময় করতে হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো ভুল হলে তাকে রাতে মিটিংয়ে সহ্য করতে হয় নানা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম মাসুদুর রহমান মিঠু বলেন, যেসব নবীণ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে ক্যা¤পাসে আসে, তারা মূলত অপরিচিত। তাদের ক্যাম্পাসের নিয়মকানুন শেখানোর জন্য গেস্ট রুমটা করানো হয়। গেস্ট রুমে যারা নেতৃত্ব দেয় তারা ছাত্রলীগ কর্মী।
এ বিষয়ে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে গভীর রাতে হলের বিভিন্ন রুমে নবীণ শিক্ষার্থীদের মিটিংয়ে (গেস্ট রুমে) র্যাগিং ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। আমরা প্রশাসন চেষ্টা করি বন্ধ করার জন্য। কিন্তু সিনিয়র ছাত্ররা আমাদের কথা শুনে না। তারা আবার ক্যাম্পাসের শাখা ছাত্রলীগ কর্মী। তবে ক্যাম্পাসে (ম্যানারিজম) আচরণ শেখানোর নামে যে র্যাগিং ও শারীরিক নির্যাতন করা হয় তা বন্ধে দ্রুত প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে।
এদিকে এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহাম্মদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।