পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়া-এ তিন নদীর সংগমস্থল মেঘনা মোহনা যেন নৌপথের ‘মৃত্যুকূপ’। স্থানীয়ভাবে এটি কোরাইলার মুখ নামেই পরিচিত। নদীগুলো তিন দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাওয়ায় সেখানে পানির বিশাল এক ঘূর্ণিগর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত নদীর তীর অগভীর থাকে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, নদীর তীরে হওয়া সত্ত্বেও চাঁদপুরের এই মোহনা অনেক গভীর।
বর্ষায় পানির ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি দেখে যে কেউই আঁতকে ওঠে। এখানে পড়ে নিখোঁজ হয়েছে শত শত মানুষ, লঞ্চসহ কার্গো কিংবা ট্রলার। এ ঘূর্ণিগর্তের কারণে সরকারিভাবেও চাঁদপুরকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পরও বাধ্য হয়ে এ নৌপথ দিয়েই প্রতিদিন চরাঞ্চলের বহু ট্রলার যাত্রী নিয়ে পাড়ি দিচ্ছে পদ্মা-মেঘনা।
চাঁদপুর সদর, মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ ও হাইমচর উপজেলায় প্রায় ৪০টি চরাঞ্চল রয়েছে পদ্মা-মেঘনার উপকূলীয় এলাকায়। যেখানে যোগাযোগের একমাত্র বাহন ইঞ্জিনচালিত নৌকা (ট্রলার)। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই দৈনন্দিন কাজ ও চিকিৎসার জন্য জেলা ও উপজেলা সদরে আসে সেখানকার মানুষ। পথে মেঘনা মোহনা পার হতে গিয়ে ট্রলারডুবিতে অনেককেই মৃত্যুবরণ করতে হয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশন মোলহেডে অর্থাৎ ত্রিনদীর মোহনায় ২৪ ঘণ্টায়ই বইতে থাকে প্রবল ঘূর্ণি¯্রােত। বর্ষা শেষে শরৎ শুরু হলেও নদীর স্রোত ও ঢেউ কমেনি। এর মধ্যেই জীবন বাজি রেখে মাল ও যাত্রীবোঝাই ট্রলারগুলো ছুটছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। চাঁদপুরের ব্যবসায়িক এলাকা পুরানবাজারে প্রতিদিনই মালবোঝাই বড় বড় কার্গো কিংবা ট্রলার আসে। নদীর ঢেউ এবং ¯্রােত বেড়ে গেলে অনেক সময় এসব নৌযান নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় বলে জানা গেছে। প্রচুর গভীর হওয়ায় ওইসব নৌযান উদ্ধার করাও সম্ভব হয় না।
স্থানীয়রা জানান, কোরাইলার মুখে যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবছে সেই পাকিস্তান আমাল থেকেই। এর মধ্যে এমভি শাহজালাল, মদিনা, দিনার ও নাসরিন-১ লঞ্চডুবি আলোচিত ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় শত শত যাত্রী প্রাণ হারিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এমভি নাসরিন লঞ্চটি, যার প্রায় ৯০ ভাগ যাত্রীরই মৃত্যু হয়েছে। আর এখানে ডুবে যাওয়া কোনো লঞ্চেরই সন্ধান পায়নি বিআইডব্লিউটিএ। এ যেন আটলান্টিক মহাসাগরের সেই বারমুডা ট্রায়েঙ্গেল! এ মোহনা নিয়ে লোকমুখে অনেক গল্পও প্রচলিত রয়েছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী হাজি মো. সামছুল হক প্রধানিয়া বলেন, ‘আমি ১৯৬৯ সাল থেকে এখানে ব্যবসা করছি। তখন থেকেই দেখে আসছি মোলহেড মোহনায় নদীর স্রোত। তীব্র এ স্রোতের তোড়ে মোলহেডের প্রায় আধা কিলোমিটার বিলীন হয়ে গেছে নদীতে; যেখানে মাছের আড়ত, পাইলট হাউজ ও দুটি স্টিমারঘাট ছিল। দিন যত যাচ্ছে ততই ঝুঁকি বাড়ছে।’ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে স্রোত বৃদ্ধির মূল কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিপরীত পাশে চর জেগে ওঠাই এর অন্যতম কারণ। তবে এর গতিপথ পরিবর্তন করতে পারলে এখানে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।’
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কাউন্সিলর ফরিদা ইলিয়াস বলেন, ‘মোহনায় প্রতিনিয়তই বেড়ে চলেছে দুর্ঘটনা। প্রায় ডুবছে জেলে নৌকা, মালবোঝাই ট্রলার ও যাত্রীবাহী ট্রলার। আমরা এসব দুর্ঘটনা এড়াতে সর্বদাই কাজ করছি। তবে যতদিন ডুবোচর এবং বিপরীত পাশের চরগুলো খনন না করা হবে, ততদিন এ স্থানের স্রোত কমবে না। আর স্রোতের কারণে শহররক্ষা বাঁধও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’
চাঁদপুর নৌ-থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবু তাহের বলেন, ‘মোহনাটিতে সব সময়ই প্রবল ঘূর্ণি স্রোত বয়ে যেতে থাকে। এ কারণে নৌযানগুলো দুর্ঘটনার শিকার হয়। বিশেষ করে নৌকা-ট্রলারগুলো বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয়।’ চাঁদপুর নদীবন্দর কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক অবশ্য বলেন, ‘ঝুঁকিপূর্ণ এ স্থানটি যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত। আমরা বড় বড় মালবাহী জাহাজ কর্তৃপক্ষকে বলে দিয়েছি, যাতে পাইলট নিয়ে জাহাজ চালায়। এ ছাড়াও মোহনাটির পাশ দিয়ে ফিটনেসহীন লঞ্চ ও জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।’