মতিঝিল ক্লাবপাড়ার `ক্যাসিনোর হোতা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ। সাম্প্রতিক ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পরই সাঈদ বিদেশে চলে গেছেন। কালের কণ্ঠ সূত্র জানতে পেরেছে তিনি এখন রাশিয়ায় স্থায়ী হয়ে সেখান থেকে নানা দেশে যাতায়াত করছেন।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক ও ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি সাঈদ। কাউন্সিলর হওয়ার পর জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ভবন দখল করে তিনি গড়ে তোলেন টর্চার সেল। যে কোনো বিষয়ে কেউ তার নির্দেশ না মানলেই টর্চার সেলে এনে নিপীড়ন করা হতো।

কয়েকদিন আগেও রাজধানীর ক্যাসিনোর বড় একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল কাউন্সিলর সাঈদের হাতে। সেসব ক্যাসিনো থেকে উপার্জিত বিপুল টাকা এখন রাশিয়ার ব্যাংকে রয়েছে বলে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা নিশ্চিত করেছে। একসময়ের তেল চুরির ব্যবসা করা মমিনুল হক সাঈদ এখন এলাকায় যান হেলিকপ্টারে চড়ে। এমপি হতে চান আগামী দিনে। এ জন্য দোয়া চেয়ে এলাকায় সাঁটিয়েছেন রংবেরঙের পোস্টার, যা ঝুলছে এখনো।

এই কাউন্সিলর বিভিন্ন ক্লাবের সঙ্গে জড়িত কয়েক বছর ধরেই। আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব তাঁকে দিয়েছে সংগঠকের সুখ্যাতি আর  সেসব ক্লাবের গায়ে ক্যাসিনোর কালি মাখিয়ে এখন তিনি অভিযোগের কাঠগড়ায়। ক্লাবগুলোতে র‌্যাবের অভিযানের আগে তিনি সিঙ্গাপুর চলে যাওয়ায় রক্ষা পেয়েছেন।

গত সপ্তাহেই সাঈদকে ধরার একটি সুযোগ হারিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। গত সপ্তাহে দেশের গোয়েন্দারা জানতে পারেন, কোনো এক দিন কাউন্সিলর সাঈদ ভারতের ত্রিপুরা দিয়ে আখাউড়া সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে তার ঘনিষ্ঠ এক আত্মীয়ের বাড়িতে অবস্থান নেবেন। দেশে জরুরি কিছু সম্পদের দলিলপত্র সম্পাদন করেই আবার তিনি ফিরে যাবেন রাশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরে। খবর পেয়েই গোয়েন্দারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে সাঈদের নিজ বাড়ি এবং আশপাশে থাকা তার আত্মীয়স্বজনের বাড়িগুলোর প্রতি সার্বক্ষণিক নজরদারি শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবে খবরটি পেয়ে কাউন্সিলর সাঈদ দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত হঠাৎ বদল করেন এবং শনিবার তিনি রাশিয়া থেকে থাইল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দেন।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হওয়ার পরই সাঈদ গা ঢাকা দিয়ে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। সেখান থেকে তিনি চলে গেছেন রাশিয়ায়। দুই বছর আগেই রাশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ে তোলেন কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ। সেখানকার দুটি শহরে তার অভিজাত একাধিক ফ্ল্যাট কেনা রয়েছে। সেখানে গড়ে তুলেছেন ব্যবসা-বাণিজ্যও।

২৩ জুন বিনা অনুমতিতে সাইদের বিদেশ ভ্রমণ আটকাতে পুলিশের বিশেষ শাখার পুলিশ সুপারকে চিঠি দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। অথচ এর পরও তিনি সিঙ্গাপুরে যেতে সক্ষম হন।

শুধু দেশে নয়, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে মমিনুল হকের ক্যাসিনোর ব্যবসা আছে। মাসে দু-তিনবার তিনি বিদেশে যাওয়া-আসা করেন। রাজধানীতে মাদক ও ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হওয়ার পর গা ঢাকা দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের এ কাউন্সিলর।

বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকা সাঈদ পাচার করেছেন সিঙ্গাপুর ও রাশিয়ায়। রাশিয়ায় সাইদের নামে তিনটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। রাশিয়ায় সেকেন্ড হোম গড়ে তুলেছেন তিনি। মদ, জুয়া আর সুন্দরী নারীর জন্য রাশিয়ায় ঘন ঘন যান। রাশিয়ার ব্যাংকে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করেন টাকা।

সাঈদের শুরুটা অবশ্য একেবারেই সাদামাটা ছিল। গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থেকে ২০০২ সালে সাঈদ ঢাকায় আসেন। এরপর মতিঝিলের দিলকুশা সাধারণ বীমা করপোরেশনের সামনের সড়কে দোকানদারি শুরু করেন। গাড়ির চোরাই তেলের ব্যবসাও করতেন তিনি। থাকতেন বঙ্গভবনের চার নম্বর গেটের কোয়ার্টারে। সেখানে তার মামা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর চাকরি করতেন। পরে মোহামেডান ক্লাবে হাউজি খেলার সময় আলমগীর ও তাপসের ফুটফরমায়েশ খাটতেন। ২০০৭ সালের পর যুবলীগের এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তার সখ্য হয়। সেই নেতার হাত ধরেই সাঈদ ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি হন। পরে যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম-সম্পাদক হন তিনি।