শর্ত মানলে খেলতে পারবেন এক বছর পরই

প্রায় সাড়ে ছয় বছর আগে এভাবেই আরেকবার কেঁপে উঠেছিল বাংলাদেশের ক্রিকেট। তখন মোহাম্মদ আশরাফুলের বিরুদ্ধে ম্যাচ পাতানোর তদন্তে সাক্ষ্য দিয়ে সহযোগিতা করা সাকিব আল হাসান এত দিন পর আবারও ‘সহযোগী’র ভূমিকায়। তবে এবারের সহযোগিতা তাঁর নিজের বিরুদ্ধে তদন্তেই। তাতেই লেখা হলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেকটি হৃদয়ভেদী অধ্যায়। সেটির মলাট উল্টানোর জন্যই মঙ্গলবার দিনজুড়ে কয়েক ধাপে চলল কেবলই অপেক্ষা আর অপেক্ষা। সন্ধ্যার আগে এবং সন্ধ্যার পরেও।

প্রথম ধাপে বাইরে অপেক্ষা, অপেক্ষা ভেতরেও। বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পরিচালনা পর্ষদে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে অপেক্ষার একপর্যায়ে বাইরে এসে অপেক্ষমাণ সংবাদমাধ্যমকে মুখপাত্র জালাল ইউনুস জানিয়ে যান, ‘আমরাও অপেক্ষায় আছি। কিসের অপেক্ষা, সেটি তো আপনারা জানেনই।’ সেই অপেক্ষা জুয়াড়ি দীপক আগরওয়ালের সঙ্গে যোগাযোগের খবর আইসিসির অ্যান্টি-করাপশন ইউনিটকে (এসিইউ) অবহিত না করার অপরাধে সাকিব আল হাসানের রায় ঘোষিত হওয়ার। অবশেষে সেই অপেক্ষা ফুরায় সন্ধ্যা ৬টার পর। বাংলাদেশ ক্রিকেটের আরেকটি ‘কালো দিন’ হিসেবে ২০১৯-এর ২৯ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক সিল-ছাপ্পড়ও পড়ে যায় তখনই। আশরাফুল অঝোরে কেঁদেছিলেন। তবে সাকিব কাঁদলেন না একটুও। না কাঁদলেও অভিব্যক্তিতে ঠিকই ফুটে উঠছিল ভেতরে বয়ে যাওয়া বাঁধভাঙা কান্নার স্রোত।

আইসিসির অ্যান্টি-করাপশন কোডের একই ধারা (২.৪.৪) তিনবার ভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রথমে নিজেদের ওয়েবসাইটে দুই বছরের জন্য সব ধরনের ক্রিকেট থেকে সাকিবকে নিষিদ্ধ করার খবর দেয়। তবে দোষ স্বীকার করায় পরের এক বছরের শাস্তি স্থগিত থাকবে বলেও জানানো হয় সংস্থাটির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে। সেই সঙ্গে এ-ও জানিয়ে দেওয়া হয় যে দোষ এবং শাস্তি মেনে নেওয়ায় এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করারও কোনো সুযোগ নেই বাংলাদেশ দলের সাবেক অধিনায়কের। ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো ধরনের ক্রিকেটই খেলতে পারবেন না এই অলরাউন্ডার। অর্থাৎ আগামী বছর ১৮ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠেয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও খেলা হবে না বহির্বিশ্বে ‘বাংলাদেশের মুখ’ সাকিবের। তবে প্রথম বছরের নিষেধাজ্ঞা কাটানোর সময় নতুন করে কোনো আইন না ভাঙলে পরবর্তী এক বছরের শাস্তি মওকুফও হবে তাঁর। সে ক্ষেত্রে ২০২০ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে আবার সব ধরনের ক্রিকেটে ফিরতেও কোনো বাধা নেই সাকিবের।

অনিবার্য নিয়তি নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর শুরু অপেক্ষার দ্বিতীয় পর্বের। যে পর্বে চলতে থাকে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে সাকিবের আসার অপেক্ষা। তিনি এলেই যে যৌথ সংবাদ সম্মেলন হবে। সেই অপেক্ষা চলতেই থাকে। আর ততক্ষণে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের মেইন গেটে জড়ো হয়ে যান শতাধিক সাকিবভক্ত। যাঁরা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকেন। সেখানেই সাকিবকে ক্যামেরায় ধরার জন্য ছিল সংবাদমাধ্যমের অপেক্ষা। কিন্তু তিনি ভেতরে ঢোকেন অন্য গেট দিয়ে। নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে। বিসিবির লিফটে ওপরে ওঠার পর চলে যান সভাপতির কক্ষে। কিছুক্ষণ পর দুজনই আসেন সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে নিজের বক্তব্য পড়ে শোনান সাকিব। শোনান ‘আরো শক্তভাবে’ ফিরে আসার প্রতিজ্ঞার কথাও। অভয় দেন বিসিবি সভাপতি নাজমুলও, ‘ভেঙে পড়ার কোনো কারণ নেই। আমরা ওর পাশেই থাকব।’

নিজের বিরুদ্ধে তদন্তে এসিইউর কর্মকর্তাদের পাশে থেকেছেন সাকিবও। সে জন্য সাধুবাদ পেলেও নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর কোনো সুযোগই ছিল না তাঁর। এই বছরের ২৩ জানুয়ারি এবং ২৭ আগস্ট বাংলাদেশে দুই দফায় তাঁর সাক্ষাৎকার নেন এসিইউর কর্মকর্তারা। ওই সময়ই জুয়াড়ি আগরওয়ালের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি জানানোর ক্ষেত্রে একাধিকবার নিজের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে নেন এই অলরাউন্ডার। বিস্তারিত তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সাকিবের সঙ্গে জুয়াড়ি আগরওয়ালের যাবতীয় যোগাযোগ হয়েছে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসের মধ্যে অন্তত তিনবার এসিইউকে জানানোর মতো বার্তা আদান-প্রদান হয়েছে সাকিব ও আগরওয়ালের মধ্যে। এর কিছুই না জানানোর অপরাধ স্বীকার করে সাকিবের নিষিদ্ধ হওয়ার দিনটি সাবেক অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের চোখে, ‘বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে দুঃখের দিন।’

দুঃখের দিন এসেছিল আগেও। সেবার তদন্তে সহযোগিতা করা সাকিব আবারও ‘সহযোগী’। তবে এবার নিজের বিরুদ্ধেই!