জোটের প্রধান মিত্র জামায়াত নিয়ে বিএনপির ভেতরে আগে কিছু মতভেদ থাকলেও এখন অনেকটাই বদলে গেছে অবস্থা। তৃণমূলের পাশাপাশি দলের বেশির ভাগ সিনিয়র নেতাই এখন চাইছেন, জামায়াত জোট ছেড়ে চলে যাক। এ বিষয়ে এখন তাঁরা লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সম্মতি আদায়ের চেষ্টা করছেন। এ জন্য ঢাকায় দলীয় নেতাদের বড় অংশই তৎপর বলে নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

বিএনপির ঢাকায় থাকা নেতারা মনে করেন, তাঁরা সবাই মিলে চাইলেও জামায়াতের সঙ্গে জোট ভাঙা যাবে না। এ জন্য দলের চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়া এবং লন্ডনে থাকা তারেক রহমানের সম্মতি লাগবে। ওই সম্মতি আদায় করা সম্ভব বলেও তাঁরা মনে করেন। তাঁদের মতে, দলে তারেক রহমান জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত নন।  

দলীয় সূত্রে জানা যায়, সুধীসমাজের বিএনপিপন্থী দু-একজন প্রতিনিধি ছাড়াও নানা মাধ্যমে দলের নেতারা তারেকের কাছে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে বিদ্যমান বাস্তবতায় দক্ষিণপন্থী দল জামায়াতকে নিয়ে আর সামনে এগোনো সম্ভব নয়। পাশাপাশি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে জামায়াত নিয়ে কোন কূটনীতিক কী মনোভাব ব্যক্ত করেন তাও তাঁরা তারেক রহমানকে জানানোর চেষ্টা করছেন।  

যদিও অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও গত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন পাওয়া যায়নি বলে মনে করে বিএনপি। অনেকের মতে, ওই নির্বাচনে ধানের শীষ মার্কায় জামায়াতকে ২২টি আসনে নির্বাচন করতে দেওয়ায় বিএনপির বড় ক্ষতি হয়েছে। তবে এত দিন ওই আলোচনা বিএনপির ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকলেও সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিকদের সঙ্গে বিএনপির একাধিক বৈঠকের পর জামায়াত প্রসঙ্গ নতুন করে সামনে চলে আসার খবর পাওয়া গেছে।

সূত্র মতে, গত ৬ নভেম্বর বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে জামায়াত প্রসঙ্গে নতুন করে কথা তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যালিস ওয়েলস। বারিধারায় মার্কিন দূতাবাসে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে অ্যালিস ওয়েলস বলেন, ব্যাপক জনসমর্থন থাকায় বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহী। কিন্তু জামায়াত সঙ্গে থাকলে তাদের জন্য কিছু করা বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় দলটির জন্য কঠিন হবে। বিএনপির নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেলেও সেদিনের বৈঠকে উপস্থিত কোনো নেতা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ধরনের বৈঠকের খবর বাইরে বলাটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের মধ্যে পড়ে না। ফলে আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না।’

বৈঠকে উপস্থিত আরেক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের বিষয়ে তাঁরা জানতে চেয়েছেন এবং তখন জামায়াত প্রসঙ্গ এসেছে। আর জামায়াতকে যে আমরা বোঝা হিসেবে টানছি এ কথা তো সত্যি।’

ওই বৈঠকে আমীর খসরু ছাড়াও ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল। এর আগে ২৮ অক্টোবর রাজধানীর একটি হোটেলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপির প্রায় ২০ বছরের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতকে নিয়ে দলে নতুন করে আলোচনা হয়নি। তাই ২০ দলীয় জোট এখনো টিকে আছে। তবে ভবিষ্যতে কী হবে সেটি সময় বলে দেবে।’

২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কূটনীতিকরা কিংবা অনেকে অনেক কথা বলেন বলে শুনি। তবে এটুকু বলতে পারি, এখন পর্যন্ত জোট অটুট আছে।’

জামায়াতের নবনির্বাচিত আমির ডা. শফিকুর রহমান এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা একটি সংকটকাল অতিক্রম করছি। এখন কথা না বলাই ভালো।’

১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করেছিল বিএনপি। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে ওই জোট ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে হামলার পর বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক নতুন অবস্থার উদ্ভব হয়। ‘ইসলামপন্থী’ দলগুলো চাপের মুখে পড়ে। অনেকের মতে, বৈশ্বিক অবস্থার নতুন ওই মেরুকরণ বিএনপি বুঝতে সক্ষম হয়নি। অথচ ওই অবস্থায় বিএনপিবিরোধী দলগুলো জামায়াতবিরোধী ব্যাপক প্রচার চালায়। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু করলে জামায়াত আরো সংকটে পড়ে। কৌশলগত কারণে বিএনপিকে তখন নীরব থাকতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জামায়াত ক্ষুব্ধ হলেও বিএনপির সঙ্গ ছাড়েনি। আবার ভোটের হিসাব-নিকাশের কারণে বিএনপিও এত দিন জামায়াতকে ছাড়েনি। তবে জামায়াত-বিএনপি জোট নিয়ে নেতিবাচক প্রচার এড়াতে ‘উদারপন্থী’ কয়েকটি দলকে নিয়ে বিএনপি গত বছর নতুন জোট গড়েছে। এর পরও নির্বাচনের ফল পক্ষে আনা যায়নি। ঘুরেফিরে এখনো সেই জামায়াত প্রসঙ্গই উঠছে।

এরই মধ্যে আবার এলডিপির সভাপতি ড. অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন গঠিত ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চে’র কর্মসূচিতে নিয়মিত জামায়াতের যোগদানের ঘটনা বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে গত কয়েক মাস যাবৎ ২০ দলীয় জোটকে সক্রিয় করার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে বিএনপি। কিন্তু হঠাৎ করেই গত ২৬ অক্টোবর গুলশানে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক ডাকা হয়। জামায়াত তাতে অংশ নেয়। তবে ওই বৈঠক নিয়ে বিএনপিতে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কারণ একই দিনে এলডিপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দেন জামায়াতের নেতা হামিদুর রহমান আযাদ। ওই অনুষ্ঠানে বিএনপির ভূমিকার সমালোচনা করা হয়।  

এ প্রসঙ্গে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিএনপির সঙ্গেও আছি, অলি সাহেবের সঙ্গেও আছি। যারাই ভালো কাজ করবে, আমরা তাদের সঙ্গেই থাকব।’