পরিবারের আগ্রহ এবং দলগতভাবে বিএনপির অবস্থান, আইনি বিধিবিধান এবং  সর্বোপরি রাজনীতির হিসাব-নিকাশ; এ রকম নানামুখী জটিলতায় আটকে আছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার কারামুক্তির প্রশ্নে তাঁর পরিবারের সদস্যরা অনেকটাই মরিয়া। কারণ তাঁদের কাছে বিষয়টি বেশ আবেগের। কিন্তু এর সঙ্গে বিএনপির অবস্থান তথা রাজনীতির হিসাব-নিকাশ মিলছে না। অন্যদিকে সরকারও এ প্রশ্নে ‘কৌশলগত’ অবস্থানে রয়েছে। একাধিক মন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের ভাষ্য থেকে জানা যায়, খালেদার প্যারোল ও সাজা স্থগিতের আবেদন করা হলে সরকার তা বিবেচনা করবে। কিন্তু বিএনপি মনে করছে, সরকার এ নিয়ে রাজনীতি করছে। আর রাজনীতির এই খেলায় না হারতে দলটি ওই উদ্যোগ থেকে দূরে আছে। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার কারামুক্তি প্রশ্নে দেনদরবার শুরু করেছেন।

খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠানোর জন্য সর্বশেষ গত মঙ্গলবার মেডিক্যাল বোর্ডের সুপারিশ চেয়ে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত আবেদন করা হয়েছে বিএসএমএমইউর (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) উপাচার্যের কাছে; যেখানে চিকিৎসাধীন আছেন বিএনপি প্রধান। ওই আবেদন করার পর তাঁর বোন সেলিমা ইসলাম জানিয়েছেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা প্রতিনিয়ত খারাপ হচ্ছে এবং তাই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে প্যারোলে হলেও তাঁরা তাঁর মুক্তি চান।

তবে এই আবেদনে তাঁর মুক্তি মিলবে কি না তা নিশ্চিত নয়। কারণ সংশ্লিষ্ট আদালত চাইলেই কেবল মেডিক্যাল বোর্ড তাঁর স্বাস্থ্যগত রিপোর্ট দাখিল করতে পারবে। এর বেশি কিছু নয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির প্রবীণ আইনজীবীদের দু-একজন কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ওই আবেদনে কোনো লাভ হবে না।

বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়ার ভাই আমার কাছে একটি আবেদন করেছেন মানবিক কারণে তাঁকে বিদেশ নিতে পরামর্শ দেওয়ার জন্য। আমি এখন ওই আবেদনটি সংশ্লিষ্ট মেডিক্যাল বোর্ডের কাছে দিয়ে দিচ্ছি। তারা বেগম জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা দেখবে।’ তিনি বলেন, ‘তবে এটা ঠিক যে ওই আবেদনের বিষয়ে আমাদের এখান থেকে খুব একটা কিছু করার আছে বলে মনে হয় না, চিকিৎসার বিষয়টি ছাড়া। কারণ আদালতের সিদ্ধান্তের বাইরে আমরা কিছু করতে পারব না। আদালত যদি কোনো সিদ্ধান্ত দেয় আমরা সে অনুসারে কাজ করব।’

উপাচার্য বলেন, ‘মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে আলাপ অনুসারে আমি যতটা জানি সেটা হচ্ছে বেগম জিয়ার যে চিকিৎসা প্রয়োজন সেটা এখানেই সম্ভব। বিশেষ করে আর্থ্রাইটিসের সর্বোচ্চ চিকিৎসা আমাদের এখানেই হয়। কিন্তু সেই চিকিৎসা নিতে এখন পর্যন্ত তিনি সম্মত হচ্ছেন না।’

জানা গেছে, দুই কারণে কারামুক্তির প্রশ্নে বিএনপি সম্পৃক্ত হতে চাইছে না। প্রথমত, খালেদা জিয়ার মনোভাব তারা জানে না। দ্বিতীয়ত, প্যারোল বা সাজা স্থগিত—দুটিতেই দল তথা খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। আর এতে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে দলটির নেতারা মনে করেন। তাঁদের মতে, দুটি উদ্যোগেই খালেদা জিয়াকে ‘নতি স্বীকার’ করতে হবে। আর এটি সরকার চাইছে বলেও বিএনপি নেতারা মনে করেন। ফলে ‘আবেগপ্রবণ’ হয়ে পরিবারের সদস্যরা প্রয়োজনে প্যারোলে মুক্তি নিতে রাজি হলেও দলগতভাবে বিএনপি তাতে রাজি হচ্ছে না। আবার খালেদা জিয়ার ‘জীবন-মরণের’ প্রশ্নে তারা বাধাও দিতে পারছে না। ফলে ইচ্ছা করেই বিএনপি নেতারা ওই উদ্যোগ থেকে দূরে আছেন বলে জানা গেছে। পরিবারের ওই উদ্যোগ সম্পর্কে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কিছু নেতা জানলেও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁরা সম্পৃক্ত হতে চাইছেন না।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বুধবার বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া প্যারোলে মুক্তি চান কি না এ বিষয়ে আমাদের কিছু জানা নেই।’ তবে তিনি স্বীকার করেছেন, খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য সব ধরনের চেষ্টা চলছে। ফখরুল আরো বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে প্যারোলের জন্য আবেদন করা হয়েছে কি না তাও আমাদের জানা নেই। তবে আমরা তাঁকে মুক্ত করতে এবং বাঁচাতে চাই, সুস্থ করে জনগণের সামনে নিয়ে আসতে চাই।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারামুক্তি বিষয়ে যে আবেদনের কথা বলা হচ্ছে সেটি পারিবারিক। কারণ এ ক্ষেত্রে তাদের সংবদেনশীলতা অন্য রকম। দলগতভাবে বিএনপি এর সঙ্গে যুক্ত নয়।’

খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতে, ‘সরকার ইচ্ছা করলে প্যারোল বা সাজা স্থগিত করে দুভাবেই মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু তারা খালেদা জিয়া ও বিএনপিকে ছোট করার জন্য রাজনীতি করবে—এটি স্বাভাবিক। কিন্তু যেকোনো মূল্যে নেত্রীকে আগে বাঁচানো জরুরি বলে আমি মনে করি।’ এক প্রশ্নের জবাবে প্রবীণ এই আইনজীবী বলেন, ‘সরকার সুয়োমোটো হয়ে উদ্যোগ না নিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসংক্রান্ত আবেদন করতে হবে।’

গত বছর মার্চ ও এপ্রিল মাসে খালেদা জিয়ার প্যারোল নিয়ে নানামুখী গুঞ্জনের মুখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ একাধিক নেতা জানান, খালেদা জিয়া প্যারোল চাইলে সরকার বিবেচনা করবে। তবে আড়ালে কিছুটা দেনদরবার হয়েছে বলে অনেকে ধারণা করলেও বিএনপি ওই সময় জামিনের জন্য চেষ্টা করে। তা ছাড়া সমঝোতার মধ্য দিয়ে খালেদা জিয়া ওই সময় প্যারোল নিতে রাজি হননি বলে পরে বিএনপি নেতাদের কাছ থেকে জানা যায়। অবশ্য বর্তমানে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ বলে মনে করা হয়। এ কারণে পরিবারের সদস্যরা শঙ্কিত হয়ে চেষ্টা-তদ্বির বেশি করছেন বলে জানা যায়।