রাজধানী ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে স্থাপিত দেশের প্রথম বেসরকারি বিটুমিন কারখানা ‘বসুন্ধরা বিটুমিন প্লান্ট’ উদ্বোধন করা হলো। সরকারি-বেসরকারি নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও অবকাঠামো নির্মাণ খাতে গতি আনতে বেসরকারি পর্যায়ে বিটুমিন উৎপাদনের পদক্ষেপ নিয়েছে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপ। আজ শনিবার বেলা পৌনে ১২টায় পবিত্র কোরআন তেলায়াতের মাধ্যমে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। একে একে বক্তব্য রাখেন উপস্থিত অতিথিরা।
বসুন্ধরা গ্রুপের সিস্টার কনসার্ন বসুন্ধরা অয়েল অ্যান্ড গ্যাস কম্পানি লিমিটেড নির্মিত এই কারখানা আজ শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত আছেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, বিশেষ অতিথি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং অনুষ্ঠানের সভাপতি আহমেদ আকবর সোবহান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর। এ ছাড়া বিশিষ্টজনরা উপস্থিত আছেন।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমি খুবই সৌভাগ্যবান আজ আপনাদের সাথে এখানে একত্রিত হতে পেরেছি। বসুন্ধরা গ্রুপের এই উদ্যোগের কারণে আমি এখানে এসেছি, আপনাদের সবাইকে কাছ থেকে দেখতে পারছি। ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের এই মাসে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আর কিছুদিন পরই জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর শুভক্ষণ অপেক্ষা করছে। আজ বসুন্ধরার এই উদ্যোগ জাতির পিতার স্বপ্নের সাথে জুড়ে রয়েছে। আমাদের দেশের মানুষকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এ কাজে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা সরকারের সহযোগিতা পাচ্ছেন। বিটুমিন নিয়ে আমরা অনেক যুদ্ধ করেছি। অনেক আলোচনা করেছি। কিন্তু সমাধান পাইনি। আমাদের আবহাওয়ার সাথে খাপ খায় এমন বিটুমিন আমরা পাচ্ছিলাম না। তাছাড়া নানা কারণে গুণগত উৎকর্ষতা ধরে রাখতে পারতাম না। যে বিটুমিন ব্যবহার করতাম তা দিয়ে আমাদের রাস্তাগুলো টেকসই হতো না। প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপ করে বলতেন, আমাদের রাস্তাগুলো কবে উন্নত দেশের মতো হবে? আজ আমরা আনন্দিত, বসুন্ধরা সেই কাজটি করে দিচ্ছে। বসুন্ধরার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমাদের আর বাইরে থেকে বিটুমিন আমদানি করতে হবে না। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও তাঁরা এ পণ্য পৌঁছে দেবেন। এটাই বাংলাদেশের জন্যে বড় অর্জন।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি আমরা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পথে প্রাইভেট খাত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতার স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছেন। সেই স্বপ্ন পূরণে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের জোগান দিতে দেশে যাঁরা এগিয়ে এসেছেন তাদের সম্মুখভাগে রয়েছে এই বসুন্ধরা গ্রুপ।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের পর উপভোগ্য লেজার শো প্রদর্শন করা হয়। সেখানে বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি খাতের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘বসুন্ধরা বিটুমিন প্লান্ট’র চিত্র মূর্ত হয়ে ওঠে।
পরিশোধিত ক্রুড অয়েলের উপজাত থেকে তৈরি বিটুমিন সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। আর বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমদানি করা বিটুমিনের ওপর নির্ভরশীল। দেশে বিটুমিনের মাসিক চাহিদা ৪২ হাজার টন। এই চাহিদা প্রতিবছর গড়ে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। বসুন্ধরা বিটুমিন প্লান্ট এককভাবে বছরে সাড়ে আট লাখ মেট্রিক টন বিটুমিন উৎপাদন করতে পারবে। ফলে সরকারের বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
সূত্র জানায়, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে একই সঙ্গে সময়মতো চাহিদার জোগান এবং গুণগত মান নিশ্চিত করতে বেসরকারি খাতে বসুন্ধরা গ্রুপই দেশে প্রথমবারের মতো বিটুমিন উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। এই কারখানায় উৎপাদিত বিটুমিন মানগত দিক দিয়ে সাধারণ বিটুমিনের চেয়ে আরো উন্নত হবে। এটি হবে বিশ্বের সেরা ব্র্যান্ডের বিটুমিনের সঙ্গে তুলনীয়। এ ছাড়া ক্রেতার চাহিদামতো গ্রেড ও মানের বিটুমিন সরবরাহ করা যাবে।
বসুন্ধরা বিটুমিন কারখানাটি স্টেট অব আর্ট অবকাঠামো হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে রয়েছে উন্নত মানের সব সেবা ও সুযোগ-সুবিধা। ক্রেতাকে চাহিদা অনুয়ায়ী সময়মতো ড্রাম বা বাল্ক আকারে বিটুমিন সরবরাহ দেওয়ার জন্য কারখানা এলাকায় দক্ষ ও মানসম্পন্ন সুযোগ-সুবিধার অবকাঠামোও গড়ে তোলা হয়েছে। নতুন কারখানাটি চাহিদা অনুযায়ী উন্নত গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন করবে। কাটব্যাক, এমালসিফাইড, অক্সিডাইজড ও পলিমারসহ (এসবিএস, রাবার পাউডার) ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন ও সরবরাহে সক্ষম এই প্লান্ট।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নিয়ন্ত্রণাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি অভ্যন্তরীণভাবে কিছু বিটুমিন উৎপাদন করে। চাহিদার বাকি ৯০ শতাংশই মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর আমদানি করা বিটুমিনের মান নিয়ে প্রশ্ন আর অভিযোগ উঠেছে বারবার। বলা হয়েছে, নিম্নমানের হওয়ায় এসব বিটুমিন সড়কে ব্যবহারের পর তা টেকসই হচ্ছে না। এতে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের সদ্ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। আবার সরকারকে চাপে পড়ে আবার নতুন প্রকল্পও নিতে হয় মাঝেমধ্যে। এ অবস্থায় দেশেই সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন বিটুমিন উৎপাদনের পরিকল্পনা পুরো অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ইতিবাচক বড় ভূমিকা রাখবে। আর বসুন্ধরা বিটুমিন প্লান্টটিও স্থাপন করা হয়েছে সেই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে। এখানে আদর্শ বিপণন ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে। বিটুমিনের পাশাপাশি এই প্লান্টে জ্বালানি তেলসহ কিছু বাই-প্রডাক্টও উৎপাদন করা হবে।
দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপ হিসেবে বসুন্ধরা এরই মধ্যে সিমেন্ট, পেপার, টিস্যু, এলপিজি উৎপাদন ও বিপণন, জ্বালানি এবং ট্রেডিং খাতে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত বসুন্ধরা বিটুমিন প্লান্টও রপ্তানিনির্ভরতা দূর করে অভ্যন্তরীণ চাহিদার অতিরিক্ত উৎপাদন করে বিদেশে বিটুমিন রপ্তানিতে উদ্যোগী হবে।