স্টাফ রিপোর্টারঃ

 এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার,শিক্ষাগত যোগ্যতা বিএ পাশ,পেশাগত জীবনের শুরুতে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন। জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার কারনে চাকুরিচ্যুত হন। ২০০২ সালে এক জঙ্গি নেতার বয়ান শুনে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে শায়খ আবদুর রহমানের কাছে বায়াত গ্রহণ করেন। এরপর জামালপুরে একটি আস্তানায় প্রশিক্ষণ নেন তিনি। জঙ্গিবাদে ব্যাপক তৎপর থাকায় দ্রুত তিনি ময়মনসিংহ অঞ্চলের নেতা হয়ে ওঠেন।
বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) ভোরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার সিটি ডেভেলপমেন্ট হাউজিংয়ের একটি আবাসিক ভবন থেকে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। তার বাসা থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি, রাসায়নিক দ্রব্য, দেশীয় তৈরি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, উগ্রবাদী বই ও নগদ তিন লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।

একইদিন বিকেলে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, জঙ্গিরা বিভিন্ন সময় লুট, ছিনতাই ও ডাকাতির মাধ্যমে সংগঠনের অর্থ জোগাড় করছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ময়মনসিংহ, জামালপুর ও রাজশাহীতে অভিযান চালানো হয়। বর্তমানে গ্রুপে গ্রুপে বিচ্ছিন্ন পুরোনো জেএমবি সদস্যরা সংগঠন চাঙা করার চেষ্টা করছে। মধ্যরাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-২ এর অভিযানে বসিলা থেকে জেএমবির একটি গ্রুপের কর্ণধার মো. এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টারকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৩ সালে মুক্তাগাছায় ব্র্যাক অফিসে ডাকাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল জঙ্গি এমদাদুল হকের। এছাড়া নাশকতা ও জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ঢাকা-ময়মনসিংহের বিভিন্ন থানায় ২০০৭, ২০১২, ২০১৫ ও ২০২০ সালে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ২০০৭ সালে মুক্তাগাছায় স্থানীয় জঙ্গি নেতাদের সঙ্গে নাশকতার গোপন বৈঠক চলাকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে এমদাদুল হক পালিয়ে যান।
তিনি আরও বলেন, গ্রেফতার এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলাভাই ও সালাহউদ্দিন সালেহীনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি জেএমবির শীর্ষ নেতাদের ময়মনসিংহে সফরকালে বিশেষ দায়িত্বে থাকতেন। বিশেষ করে নেতাদের গোপন আস্তানায় অবস্থান, মিটিং ও বয়ান আয়োজনে তিনি ভূমিকা রাখতেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে গ্রেফতার চার জঙ্গিসহ জেএমবির ১০ সদস্য তার কাছ থেকে বায়াত গ্রহণ করেন। এই ১০ জনই বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন।তিনি জানান, জঙ্গি সদস্যদের কেউ কেউ এখনো আত্মগোপনে রয়েছেন। তাদের গ্রেফতারে র‌্যাব অভিযান অব্যাহত রেখেছে। 

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের এ পরিচালক বলেন, বিভক্ত জেএমবির একটি গ্রুপের কর্ণধার জঙ্গি নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জ্বল মাস্টার। শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকরের পর সংগঠনটি নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে জেএমবি নিজেদের মধ্যে আন্তঃকোন্দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। সংগঠনের ভেতর ও বাইরে দুটি গ্রুপের সৃষ্টি হয়। জঙ্গি নেতা সারোয়ার জাহানের নেতৃত্বে জেএমবি সুসংহত হয় এবং গড়ে তোলে জেএমবি ‘সারোয়ার-তামীম গ্রুপ’।
র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালে হলি আর্টিসান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন জেএমবির আমির সারোয়ার জাহান এবং তামীম চৌধুরী। তারাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নাশকতার ছক তৈরি করেছিলেন। একই বছরের ৮ অক্টোবর র‌্যাবের অভিযানে পালাতে গিয়ে বিল্ডিং থেকে পড়ে জেএমবির তৎকালীন আমির সারোয়ার জাহান মারা যান। হলি আর্টিসান ঘটনার পর এখন পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার জঙ্গিকে (বিভিন্ন সংগঠন এবং জেএমবির আট শতাধিক সদস্য) গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। এতে জেএমবির সাংগঠনিক সক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, ২০০৭ সালে এমদাদুল হক তার নিকটাত্মীয় রফিক মাস্টারকে হত্যা করেন। রফিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তাদের (জেএমবির) বেশ কয়েকজন জঙ্গি সদস্যকে ধরিয়ে দেন। পরে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে রফিক মাস্টারকে হত্যা করা হয়। এরপর ২০০৭ সালে এমদাদুল হকের বিরুদ্ধে মামলা হলে তিনি গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে যান। ২০০৮ থেকে ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় নাম পরিবর্তন করে ছদ্মবেশে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী, খেলনা বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক ও রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।
র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ২০১২ সালে রাজধানীর উত্তরা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গ্রেফতার হন এমদাদুল হক। ‘গোপন বৈঠকে নাশকতার পরিকল্পনা’র মামলায় দুই বছর কারাগারেও ছিলেন। ২০১৫ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও বিস্ফোরকসহ গ্রেফতার হন। ২০১৬ সালে জামিন নিয়ে পুনরায় আত্মগোপনে চলে যান। এ সময়ও আগের মতো ছদ্মবেশে রাজবাড়ী, রংপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকায় অবস্থান করেন এবং জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে যান। সম্প্রতি জেএমবি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়লে সাংগঠনিক দুর্বলতা তৈরি হয়। ফলে তারা বিচ্ছিন্নভাবে স্বতন্ত্র কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়।
র‌্যাবের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, জঙ্গি এমদাদুল তার বিশ্বস্ত ও পুরোনো জেএমবি সহযোগীদের সংগঠিত করে একটি গ্রুপ তৈরির চেষ্টা চালান। এসব গ্রুপের মূল কর্ণধার ও সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। তার গ্রুপে অর্ধশতাধিক অনুসারী রয়েছে। গ্রুপটির নেটওয়ার্ক ময়মনসিংহ, জামালপুর, উত্তরবঙ্গসহ কয়েকটি জেলায় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। সংগঠনের বিভিন্ন বিষয় দেখভালের জন্য সাংগঠনিকভাবে তিনি দায়িত্বশীল হিসেবে নিযুক্ত হন। যাদের অধিকাংশই মূলধারার জেএমবির পুরোনো সদস্য রয়েছে।
গ্রেফতার জঙ্গি এমদাদুল নিজে প্রত্যক্ষভাবে অপারেশন কার্যক্রম তদারকি করতেন। তাদের আইটি সেক্টরকে সমৃদ্ধ করতে বিশেষ উদ্যোগও নেন। অপারেশন দলের পাশাপাশি ‘সাইবার ফোর্স’ গঠনে প্রাধান্য দেন। করোনাকালে সংগঠনের দাওয়াতের পাশাপাশি সদস্য সংখ্যা বাড়াতে অনলাইনে সক্রিয় হতে থাকেন। অর্থের জোগান দেওয়ার জন্য জঙ্গি এমদাদুল হক নাশকতা, ডাকাতি, ছিনতাইয়ে অংশগ্রহণ করতে তার সদস্যদের নির্দেশ দেন।