॥ কারাগারে বসে নিয়ন্ত্রণ করেন মিরপুর, কাফরুল, ভাষানটেকের আন্ডারওয়ার্ল্ড ও রাজনীতির মাঠ
॥ নির্দেশ দেন মোবাইল ফোন, আইএমও, ম্যাসেঞ্জারে
॥ অভিযোগ সত্য হলে কঠোর ব্যবস্থা: ডিআইজি প্রিজন্স টিপু সুলতান।
রাজধানীর শীর্ষসন্ত্রাসী কাইল্যা পলাশ কারাগারে থেকেও করতেন গৃহভ্রমণ। কিছু সময় কাটিয়ে আবার ঢুকতেন কারাগারে। এমনকী কারাগারে থাকা অবস্থায় সন্তানও জন্ম দিয়েছেন শীর্ষ এই সন্ত্রাসী। তার এ গল্প গণমাধ্যমের বদৌলতে অনেকেরই জানা। ঠিক একই ঘটনা ঘটেছে ঢাকার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাসের ক্ষেত্রেও।
১৬ বছর ধরে কারাবন্দি আব্বাস উদ্দিন ওরফে কিলার আব্বাস। এ সময়কালে একদিনের জন্য জামিন পাননি, কিন্তু পরিবারের সান্নিধ্য ঠিকই পাচ্ছেন এ শীর্ষ সন্ত্রাসী। কারাগারে থাকলেও প্রায়ই ‘গৃহভ্রমণ’ করেন! অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, ৪ বছর আগে ছেলে সন্তানের বাবাও হয়েছেন তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষসন্ত্রাসীর অন্যতম আব্বাস। মিরপুরে জবরদখল করা একাধিক ক্যাবল বা ডিশ লাইনের ব্যবসা চলছে তার সেই ছেলের নামে রাখা আইদান ক্যাবল নেটওয়ার্কের ব্যানারে। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনের সামনে এবং রাজধানীর কাফরুল থানাধীন কচুক্ষেত এলাকায় প্রকাশ্যে দুই ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় হওয়া মামলায় ২০০৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন ছাত্রলীগের সাবেক এ নেতা। সেই থেকে কারান্তরীণ। বর্তমানে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে (পার্ট-২) আছেন।
কিলার আব্বাসের একমাত্র ছেলে আইদান ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত। থাইল্যান্ডে তার চিকিৎসা চলছে। মা হামিদা বেগম সার্বক্ষণিক আইদানের সঙ্গে থাকছেন। মাসে অন্তত দুবার তাকে থাইল্যান্ড ও ভারতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। বেশ কিছুদিন ছেলেটি চিকিৎসাধীন ছিল রাজধানীর পান্থপথ এলাকায় অবস্থিত স্কয়ার হাসপাতালেও। আইদানের জমকালো জন্মদিনের অনুষ্ঠানও হয়েছিল বনানীর একটি পার্টি সেন্টারে। সেই অনুষ্ঠানে বর্তমান এক প্রতিমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। চাঞ্চল্যকর এ সব তথ্য মিলেছে আমাদের সময়ের অনুসন্ধানকালে আব্বাসের ঘনিষ্টজনদের বক্তব্যে।
জেলের বন্দিজীবনে থেকে আব্বাস শুধু পিতৃত্বের স্বাদই নিয়েছেন, তা নয়। সেখানে বসেই মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, আইএমও ও ম্যাসেঞ্জারে অডিও বা ভিডিও কলের মাধ্যমে রাজধানীর মিরপুর, কাফরুল, ভাষানটেক থানা এলাকায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক কারবার, ডিশ লাইনের ব্যবসা, ঝুট ব্যবসা, গরুর হাটের ইজারাসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজি করছেন তিনি। এমনকি মিরপুর বিআরটিএ অফিসকে ঘিরে যে অপরাধ সাম্রাজ্য, তাও তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন জেলে বসেই।
জানা গেছে, বিভিন্ন জনের নামে নেওয়া অর্ধশতাধিক মোবাইল সিমকার্ড রয়েছে কিলার আব্বাসের। কারাগারে বসে এসব সিম ব্যবহার করছেন তিনি। গত ৬ মাসে বাংলালিঙ্কের দুটি (০১৯৯৮৬৩৯৮৪৮ ও ০১৯০৯৭৪৬৮৬৩ এই দুটি নম্বর সেভ করা যথাক্রমে ‘দোস্ত’ ও ‘এএএএএ’ নামে) নম্বর ছাড়াও অন্তত ১৫টি নম্বর ব্যবহার করে কথা বলেছেন প্রায় প্রতিদিন। এসব সিম দিয়ে আব্বাস নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও নিজের সংঘবদ্ধ ক্যাডার বাহিনীর সঙ্গে। সিমগুলো ব্যবহার হচ্ছে চাঁদাবাজি ও হুমকির কাজেও। কারাগার থেকে তিনি যে মোবাইল ফোনে খুনের নির্দেশনা দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এর প্রমাণ রয়েছে। মিরপুর-১০ নম্বরের এক ঝুট ব্যবসায়ীর সঙ্গে আব্বাসের মোবাইল ফোনে ১৪০ সেকেন্ড কথা হয়েছে। সেই কথোপকথনের শেষ বাক্যটি ছিল, ‘পাঁচ লাখ টাকা দিবি, নইলে জান’। অথচ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিরাপত্তার জন্য রয়েছে কোজ সার্কিট ক্যামেরা, মোবাইল ফোন ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার (মুঠোফোনের নেটওয়ার্কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির যন্ত্র) এবং সার্বক্ষণিক নিরাপত্তামূলক চেক-আপের ব্যবস্থা।
অভিযোগ উঠেছে, কারাগারের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘ম্যানেজ’ করে ভেতরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন কিলার আব্বাস। আছেন রাজার হালে। সন্তানের বাবা হয়েছেন অসাধু ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি করেই। সংঘবদ্ধ এই চক্রের সঙ্গে মিলেমিশে কারান্তরীণ হয়েও মিরপুর, কাফরুল, ভাষানটেক থানা এলাকা থেকে মাসে অন্তত অর্ধ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করছেন কিলার আব্বাস।
ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স টিপু সুলতান আমাদের সময়কে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস কারাগারে বসে মোবাইল ফোন, আইএমও ব্যবহার করছেন; বাইরের অপরাধ সামরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন- বিষয়টি আমি অবগত নই। আর কারান্তরীণ কেউ বাবা হওয়ার অভিযোগতো বিষ্ময়কর; অসম্ভব। এই বিষয়টিও আমার জানা নেই। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। অভিযোগের সত্যতা পেলে জড়িতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জানা গেছে, কারাগারে বসে কিলার আব্বাস শুধু যে মিরপুর, ভাষানটেক, কাফরুলের আন্ডারওয়ার্ল্ডই নিয়ন্ত্রণ করছেন তা কিন্তু নয়। তার দিক নির্দেশনায় ঢাকা উত্তরের স্থানীয় রাজনীতিরও পটপরিবর্তন হয়ে থাকে। মিরপুর-কাফরুলের বেশ কয়েকজন প্রবীন রাজনীতিবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারদলীয় ও বিরোধী দলীয় স্থানীয় নেতা বানানোর পেছনের কারিগরও এই শীর্ষ সন্ত্রাসী। অনৈতিক সুবিধাভোগী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে আব্বাস কাফরুলসহ আশপাশ এলাকার রাজনীতির ঘুঁটি নিয়ন্ত্রণ করেন। কারাগার থেকেই আব্বাস নির্ধারণ করে দেন কমিটিতে কাকে কোন পদ দেয়া হবে। না দিলে যিনি তার বিপক্ষে অবস্থান নেন তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে সে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। যার কারণে ত্যাগী কর্মীরা কর্মের সঠিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন না।
তারা আরও জানান, মিরপুর, ভাষানটেক ও কাফরুলে কিলার আব্বাসের একক আধিপত্য। শতাধিক স্বসস্ত্র ক্যাডার দিয়ে অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন। এছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগ, ছাত্রদল, যুবদল, সেচ্ছাসেবক দলের কিছু নেতাকেও ভিড়িয়েছেন তার সিন্ডিকেটে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এইসব নেতাদের দিয়ে চাঁদাবাজী, দখলবাজী, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করান। তার সিন্ডিকেটকে চাঁদার টাকা না দিয়ে কেউই ব্যবসা করতে পারেন না; জমি কিনতে পারেন না। টাকা না দিলেই পূর্বের হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিচারণ করে হত্যার হুমকি দেয়া হয় ব্যবসায়ী ও জমির ক্রেতা-বিক্রেতাকে। চক্রটি এতটাই ভয়ঙ্কর যে, থানায় অভিযোগ জানানো দুরে থাক, তাদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না ভুক্তভোগীরা।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২ এর সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা আমাদের সময়কে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী কিলার আব্বাস কারাগারে বসে মোবাইল ফোন, আইএমও ব্যবহার করছেন; বাইরের অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে- তা সত্য নয়। কারণ, কারাবন্দিদের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ। তাছাড়া কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে কোজ সার্কিট ক্যামেরা, মোবাইল ফোন ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার মেশিন এবং সার্বক্ষণিক নিরাপত্তামূলক চেক-আপের ব্যবস্থা। এত নিরাপত্তা ভেদ করে পার্ট-২ কারাগারের কারাবন্দি কারও পক্ষেই মোবাইল ব্যবহার করা সম্ভব নয়। চার বছর আগে কিলার আব্বাস বাবা হয়েছেন এমন তথ্যে বিষ্ময় প্রকাশ করে জেল সুপার সুব্রত কুমার বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তারপরও খোঁজ খবর নিচ্ছি।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, আব্বাসের বাবার নাম সাহাবুদ্দীন ওরফে তমিজ উদ্দীন। আশির দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে গড়ে ওঠা ফাইভ স্টার গ্রুপে যোগ দেন কিলার আব্বাস। এরপর লাশের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে শীর্ষ অপরাধীর খেতাব লাভ করেন তিনি। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে ২০০২ সালে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক এক সভাপতির হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন কিলার আব্বাস। সে বছরই বাগিয়ে নেয় কাফরুল থানা ১৬ নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ। এই প্যানেলের নাম ছিলো আক্তার-আব্বাস প্যানেল। কারাগারে যাওয়ার পর আরও পরাক্রমশীল হয়ে ওঠেন ভয়ঙ্কর এই ‘খুনি’।
সূত্র আরও জানায়, জেল খানায় বসেই শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন আব্বাস। জবরদখলের মাধ্যমে তার পরিবারের লোকজন হয়েছেন বিস্তর জমির মালিক। মিরপুর-কাফরুলেই তার রয়েছে ৭টি ফাট ও ১৫টি বাড়ি। যার মধ্যে ৪টি বহুতল ভবন। কিলার আব্বাসের অপরাধ সাম্রাজ্য থেকে উঠে আসা টাকা যায় তার স্ত্রী হামিদা বেগমের কাছে। চাঁদার এই টাকা হামিদার হাতে তুলে দেন আব্বাসের কালেকটার ও স্ত্রীর ব্যক্তিগত গাড়ির চালক রহমান। মিরপুর, ভাষানটেক, কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, কচুক্ষেত এলাকার ডিশ ব্যবসার নিয়ন্ত্রক এই রহমান। ইব্রাহিমপুরের মিজানের ডিশ লাইন জোর করে দখল করে নিয়েছে আব্বাসের লোকজন। ইব্রাহিমপুরে আব্বাসের ছেলে আইদানের নামে ‘আইদান ক্যাবল নেটওয়ার্ক’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০১৭ সালে ২০ বছরের প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত জালালকে গুলি করে এটি দখল করে আব্বাসের লোকজন। একই বছর মিরপুর ১৪ নম্বর কলোনী ও ইব্রাহিমপুরের খোকনের ক্যাবল ব্যবসাও দখল করে নেয় তার লোকজন। সেগুলো দেখভাল করেন রহমান। ডিশ বাণিজ্যের একটি ভাগ যায় আব্বাসের সহযোগী আব্দুল আজিজ বাবু ওরফে ডিশ বাবুর কাছে।
এবার কোরবানির ঈদে আব্বাসের স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান ‘হামিদা এন্টারপ্রাইজের’ নামে কচুক্ষেত ও ভাসানটেকের গরুর হাট পরিচালিত হয়। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন ইসহাক, আলাউদ্দিন, কামাল ও বিপুল। অভিযোগ- জেলে বসে হুমকি দিয়ে এই দুটি গরুর হাটের টেন্ডার জমা দিতে ৪০ জন দরপত্র ক্রেতাকে ভয় ভীতি দেখায় কিলার আব্বাস। ফলে কেউই আর সাহস করেনি।
ডেভেলপার ব্যবসার নিয়ন্ত্রক আব্বাসের ভায়রা মাসুম। সরকারি হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের টেন্ডারবাজীর লাটাইও আব্বাসের অনুসারিদের হাতে। তার মনোনীত একটি প্রতিষ্ঠান (হামিদা এন্টারপ্রাইজ) ছাড়া অন্য কেউই কাজ পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের হোতাও ভায়রা মাসুম।
কথা প্রসঙ্গে কিলার আব্বাসের ভায়রা মাসুম বলেন, আইদান আব্বাস ভাইয়ের একটিই মাত্র ছেলে। আগের তুলনায় তার শারীরিক অবস্থা একটু ভালো। আইদানের বয়স জানতে চাইলে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। কারাবন্দি আব্বাস জেলখানায় বসে মোবাইল ফোনে তার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, করতে পারে, তবে আমার সাথে তার (আব্বাস) কথা হয় না। সরকারি হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের টেন্ডারবাজীর সঙ্গে নিজের কোনও সম্পৃক্ততা নাই বলেও দাবি করেন ভায়রা মাসুম।
জানা গেছে, আব্বাস মিরপুরের বিআরটিএ’র টাকা পান জাহিদ, বিপুল ও শাহীনের মাধ্যমে। তার হয়ে অন্তত ২ ডজন কর্মী বাহিনী দিয়ে ঝুট ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন হাবিবুর রহমান রাব্বি ও আব্বাসের শ্যালক ডেভিড। মাদক বাণিজ্যে বাধা দেয়ায় আব্বাসের নির্দেশে বছর খানেক আগে কাফরুল থানার ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আক্তার হোসেনের হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দেয় সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনায় সাবেক ছাত্রদল নেতা রাব্বির বিরুদ্ধে মামলাও হয়।
কিলার আব্বাসের হয়ে জমি-ফাট জবরদখল এবং এক জনের জমি জবরদখল করে অন্য জন্যকে বুঝিয়ে দেয়ার কাজে নিয়োজিত আছেন ডিএসপি বাবু, জনি দেওয়ান, আব্দুল আজিজ বাবু, সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর পি এস আলাউদ্দিন, জামাল মোস্তফা, মারুফ হোসেন, তপু, সুমন, রফিকুল ইসলাম রাজু ও আব্দুল আজিজ বাবু।২০১৭ সালে ধামালকোট ১ নম্বর দাগে এক লন্ডন প্রবাসীর জায়গা ভুয়া ভোটার আইডি কার্ড বানিয়ে এবং ভুয়া মালিক সাজিয়ে আব্বাসের লোকজন ৬০ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেয় প্রবাসী শরীফউদ্দিনসহ কয়েকজনের কাছে। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জমিটি দখল পান লন্ডন প্রবাসী। কিন্তু ভুক্তভোগী প্রবাসী শরীফ এখনও পাননি তার ৬০ লাখ টাকা।
মিরপুর-১৪ নম্বর মোড়ে ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও সরকারি জায়গা দখল করে আব্বাসের শ্যালক ডেভিড গড়ে তুলেছেন ‘ভোজবাড়ি’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টটিতে সরকারি বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস অবৈধভাবে ব্যবহার করলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আব্বাসের ভয়ে কথা বলার সাহসও রাখে না। মিরপুর-১৪ নম্বর বাস কাউন্টারে বাস, লেগুনা, ম্যাক্সি থেকে চাঁদাবাজির সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করেন আব্বাসের অনুসারী জামাল মোল্লা, টুলু ও উজ্জ্বল।
সম্প্রতি কিলার আব্বাসের হয়ে তার অন্যতম সহযোগী খুন, চাঁদাবাজিসহ আট মামলার আসামি কাফরুলের শাহীন শিকদার কচুক্ষেতে বেসরকারি হাইটেক মাল্টিকেয়ার হাসপাতাল লিমিটেডে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে হুমকি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে কাফরুল থানায় জিডি করেছেন হাসপাতালটির অন্যতম মালিক মো. সাইফুল্লাহ সাদেক। চক্রটি পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে প্রাণনাশের হুমকি দেয় কচুক্ষেতের আল আমিন বেডিং স্টোরের মালিক আবুল কালামকেও। বিষয়টি থানা-পুলিশকে জানিয়েছেন আবুল কালাম। শাহীন শিকদারের সহযোগীরা চাঁদা না পেয়ে ছয়-সাত মাস আগে কচুক্ষেতের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবসায়ী আজাদ হোসেনকে গুলি করে বলেও জানা গেছে।
পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মোস্তাক আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, বিদেশ ও কারাগারে থাকা কিলার আব্বাসসহ শীর্ষ অন্য সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা দাবির বিষয়ে মাঝে মধ্যে যে অভিযোগ পাওয়া যায়, সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারেই তদন্ত করা হয়। ইতোমধ্যে একজন কর্মকর্তাকে শুধু এই বিষয়ে এ্যাসাইন করা হয়েছে।
সন্ত্রাস নির্মূলের লক্ষ্যে ভুক্তভোগীদের নিঃসংকোচে সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের কাছে এসে অভিযোগ জানানোর আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, অভিযোগকারীর নাম-পরিচয় গোপন রেখে তদন্ত স্বাপেক্ষে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ চক্রকে আইনের আওতায় আনা হবে। কারাগারে বসে কিলার আব্বাস সন্তানের বাবা হয়েছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে অবগত নন জানিয়ে ডিসি মোস্তাক আহমেদ বলেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
জানা গেছে, আব্বাসের অপরাধ সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রক হলেন- আলাউদ্দিন, শাহীন শিকদার, মিরপর-১১ এর দিলশাদ হোসেন দিলু ওরফে কিলার দিলু ও দেলোয়ার। মিরপুর-১২ এলাকায় ইমরান মাদবর। মিরপুর-৭ এলাকায় পিচ্চি সাহাদাত, রূপনগরের ফরীদ, মিরপর-৬ এলাকায় জিয়াউল হক, সেন্টু, শামীম, মোশারফ ওরফে ১০ আঙুল কাঁটা মোশারফ। তেজগাঁও ও শিল্পাঞ্চাল এলাকায় সিটি আসিক, নুর হোসেন লেদু ও এসএম সায়েম।
কিলার আব্বাসের ভাড়াটে কিলারদের মধ্যে অন্যতম হলেন ভাষানটেকের ইমু, তপু, রহমান, রবিন, ১৪ নম্বরের জিল্লুর (বর্তমানে কারাগার), শেনপাড়ার টিটু। আব্বাস চাঁদাবাজি ও খুন খারাবি নিয়ন্ত্রণ করেন- চামাইরা বাবু, ভায়রা মাসুম, কচু ক্ষেতের রাজু, চৌধুরী বাবু, লিটন, চাকমা রাসেল, হাসান, সেনপাড়ায় নূরু, ১৩ নম্বরের আজাদ, শাহীন, শাকিল, জিল্লু ওরফে সাল্লু, রহমান, আওয়াল, স্বপন, রহিম, শাহজাহান, কালা সোহেল, সাজু, সম্রাটসহ গ্রুপের শতাধিক সদস্যের মাধ্যমে। এদের মধ্যে কয়েকজন আটক হয়েছেন বলেও আব্বাসের ঘনিষ্টজনদের বক্তব্যে উঠে এসেছে।
আব্বাসের ঘনিষ্টজনরা জানায়, আশির দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে গড়ে ওঠা ফাইভ স্টার গ্রুপে যোগ দেন কিলার আব্বাস। এরপর লাশের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে শীর্ষ অপরাধীর খেতাব লাভ করেন তিনি। ১৯৯৯ সালের ২৯ জুন একটি মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে বাসায় ফেরার পথে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে ব্যবসায়ী আতাউর রহমান আজাদকে হত্যা করেন কিলার আব্বাস ও তার গ্রুপের সদস্যরা। ২০০১ সালের ২৮ জানুয়ারি দুপুর ২টার দিকে কাফরুল থানাধীন কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা সুপার মার্কেট এলাকায় চাল ব্যবসায়ী এছহাক আহম্মেদ দুলালকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ হত্যা মামলার আসামি আব্বাস ও তার কয়েক সহযোগী। এই দুটি মামলার বিচারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীকেই আদালতে হাজির করা হয়নি। দিনের পর দিন সাক্ষীদের সমন জারি করেও মেলেনি সাড়া। এমনকী মামলার তদন্ত কর্মকর্তারাও আদালতে সাক্ষ্য না দেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও তা তামিল হয়নি। অবশেষে ২০১৫ সালে এই দুই মামলায় বেকসুর খালাস পান কিলার আব্বাস। অন্য একটি হত্যা মামলায় এখন জামিনের চেষ্টা করছেন শীর্ষ এই সন্ত্রাসী।
কারাগার থেকে কিলার আব্বাস কাফরুল ও ভাষানটেক এলাকায় মাটি ভরাটের কাজ তার গ্রুপকে দিয়ে পরিচালনা করে। এই মাটি ভরাট কাজের চাঁদার নিয়ন্ত্রণ দ্বন্দ্বে ২০১৭ সালের এপ্রিলে কাফরুলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হয় ভাষানটেক থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ঠিকাদার মুসা ওরফে চিকনা জামাল। জানা গেছে, কিলার আব্বাসের হুকুকেই সন্ত্রাসী জিল্লুরসহ ৪ জনের একটি বাহিনীর হাতে খুন হন চিকনা জামাল। দাবিকৃত চাঁদা না দেয়ায় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসেই কিলার আব্বাসের সহযোগীদের ভাড়াটে কিলাদের হাতে মিরপুর ও কাফরুলে নির্মমভাবে খুন হন দুই ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান, শাহজাহান রুবেলসহ তিনজন। পরের মাসের ৯ তারিখ পল্লবীর প্যারিস রোডে আরেক ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন মোহনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।