একটি পাঁচতারা হোটেলে যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়ার গড়ে তোলা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ডেরায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল বেশ কয়েকজন এমপি, সচিব, রাজনৈতিক নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ীর। দুদকের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গুলশানের ওই হোটেল কর্তৃপক্ষ পাপিয়ার ভাড়া করা প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটসহ কয়েকটি কক্ষে যাতায়াতকারীদের একটি তালিকা সংস্থাটির কাছে হস্তান্তর করেছে। দুদকের একটি সূত্র ওই তালিকার ভিত্তিতে কালের কণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়েছে। 

এদিকে পাপিয়া ও তাঁর স্বামীকে রিমান্ডে নেওয়া ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদ সূত্রে জানা গেছে, এই দম্পতির অবৈধ আয়ের অন্যতম মূল উৎস ছিল মাদক কারবার। স্বামী মফিজুর রহমান সুমনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা থেকে নরসিংদী পর্যন্ত মাদক সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন পাপিয়া। ক্রেতা হিসেবে তাঁদের মূল টার্গেটে ছিল স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এর পাশাপাশি সরকারি অফিসে তদবির বাণিজ্য, অস্ত্র ও জাল নোটের কারবার, চাঁদাবাজি, জমি দখল করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তাঁরা। সেই অবৈধ অর্থ রাজধানীর পাঁচতারা হোটেলে আনন্দ ফুর্তিতে ব্যয় করেছেন তাঁরা।

পাপিয়া ও তাঁর স্বামী অপরাধলব্ধ অর্থ বিদেশেও পাচার করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। সিআইডির বিশেষ তদন্ত ও গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে এর বিপুল পরিমাণ অংশ বিদেশে পাচার করেছেন পাপিয়া ও তাঁর স্বামী। আরো কিছু তথ্য-প্রমাণ পেলেই শিগগির মানি লন্ডারিং আইনে সিআইডি বাদী হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করবে।

সিআইডির বিশেষ তদন্ত ও গোয়েন্দা শাখার ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, পাপিয়া ও তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তারের পর থেকেই অর্থপাচারের বিষয়টি সামনে এসেছে। সতত্য যাচাই করতে সিআইডি খোঁজখবর নিতে শুরু করে। তারপর অর্থপাচারের নানা তথ্য পাওয়া যায়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানতে পেরেছেন, পাপিয়া বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের কাছে বিদেশি মডেল সরবরাহ করে বড় অঙ্কের টাকা নিতেন। আবার ওই মডেলদের মাধ্যমে অর্থপাচার করেছেন। বিদেশি মডেলদের মাধ্যমে অর্থপাচারের বিষয়টি যাচাই করার জন্য সিআইডি কর্মকর্তারাও রাজধানীর পাঁচতারা হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চান। জানা গেছে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য পাপিয়ার ঘনিষ্ঠজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিআইডি।

পাপিয়া ও তাঁর স্বামী কোন কোন দেশে অর্থ পাচার করেছেন জানতে চাইলে সিআইডি সূত্র জানায়, কিছু কিছু দেশের তথ্য আমরা পেয়েছি। এখন তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখছি সঠিক কি না। যদি সঠিক হয় তবে আমরা ‘অ্যাকশনে’ যাব।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, পাপিয়াসহ অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ অব্যাহত আছে।  এরই মধ্যে তাঁর বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ভিডিও এবং কিছু তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। আমরা প্রতিটি বিষয়ই আমলে নিয়েছি। এর মধ্যে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ও রিলেভেন্ট এলিমেন্ট আমরা পিক করছি। সব কিছু সাপেক্ষেই আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব। কার কার সঙ্গে সম্পর্ক, সেটিও দেখা হবে।’

সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন বলেন, পাপিয়া ও তাঁর সহযোগীদের ব্যাপারে অর্থপাচারের অনুসন্ধান চলছে। ব্যাংক, সঞ্চয় পরিদপ্তর, রিহ্যাবসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

জানা গেছে, এই অবৈধ অর্থেই স্বামী মফিজুর রহমান সুমন চৌধুরীকে নিয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন পাপিয়া। গুলশানের পাঁচতারা হোটেলে গত ১২ অক্টোবর থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ২০ দিন এবং ৫ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৩১ দিনসহ মোট ৫১ দিন ওই হোটেলের সবচেয়ে বিলাসবহুল প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটসহ আরো দুটি রুম ভাড়া নিয়ে সহযোগীদের নিয়ে সন্দেহজনকভাবে অবস্থান করেন তিনি। প্রতিদিন কম বেশি দুই লাখ ৫০ হাজার করে ৫১ দিনে এক কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা বারের বিল পরিশোধ করেন।  প্রেসিডেনশিয়াল স্যুটের ভাড়া বাবদ ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৭ টাকা নগদ প্রদান করেন।  সব মিলিয়ে দুই কোটি আট লাখ ৯২ হাজার ৮৮৭ টাকা ৩১ পয়সা ব্যয় করেন। এ ছাড়া হোটেলে অবস্থানকালে হোটেলবয় ও সার্ভিসম্যানদের প্রতিদিন আট থেকে ১০ হাজার টাকা বকশিশ দিতেন। অর্থাৎ ৫১ দিনে আট হাজার করে বকশিশের টাকাসহ প্রায় দুই কোটি ১২ লাখ টাকা হোটেলবাবদ খরচ করেছেন তাঁরা।

‘মনগড়া প্রচারণা’ সম্পর্কে পুলিশ জানে না : এদিকে পাপিয়ার মামলার তদন্ত সম্পর্কে গতকাল ডিএমপির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সামগ্রিক বিষয় এখনো তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এ বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য প্রদান করা হয়নি। কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পাশাপাশি কিছু গণমাধ্যমে তদন্তসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনো রকম আলাপ-আলোচনা না করে তদন্ত সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করা হচ্ছে। ডিএমপির উপকমিশনার (ডিসি-মিডিয়া) মাসুদুর রহমান ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলেন, তদন্তে প্রাপ্ত কথিত তথ্য হিসেবে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম ও পরিচয় প্রকাশ ও প্রচার করা হচ্ছে। যার সঙ্গে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও তদন্তসংশ্লিষ্টদের সম্পৃক্ততা নেই কিংবা তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যের সঙ্গে কোনো সামঞ্জস্য নেই। তদন্তাধীন মামলার বিষয়ে রিমান্ডে থাকা অভিযুক্তদের সম্পর্কে মনগড়া প্রচারের ফলে তদন্তকারী কর্মকর্তার ওপর মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক চাপ তৈরি হয়। যার ফলে বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বর্ণিত অবস্থার প্রেক্ষাপটে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সংশ্লিষ্ট সবাইকে পেশাদারি ও দায়িত্বশীল আচরণ প্রদর্শনের জন্য অনুরোধ করছে।