করোনাভাইরাস ডিজিজ-২০১৯-এ (কভিড-১৯) যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলেও এখনো জীবনযাত্রা অবরুদ্ধ (লকডাউন) করার পক্ষে নন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর পরিবর্তে মার্কিনদের দৈনন্দিন চলাচলে আরো কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করতে চান তিনি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, লকডাউনের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিকটিই বেশি ভাবাচ্ছে ট্রাম্পকে।
এখন পর্যন্ত লকডাউন না করে ভাইরাসটি ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখতে সক্ষম হয়েছে এশিয়ার দুই দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান। আবার স্পেন কিংবা ইতালির মতো দেশ লকডাউনে গেলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো সাফল্য পায়নি। ইতালিতে মৃতের সংখ্যা এরই মধ্যে সাড়ে ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। স্পেনে সাড়ে ছয় হাজারের ওপরে।
গতকাল রবিবার পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশ ও অঞ্চল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত লাখের ওপরে। মারা গেছে ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ। তবে আক্রান্ত কিংবা মৃত্যুর দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ।
আক্রান্তের ৫৩ শতাংশ ইউরোপে
করোনাভাইরাসে ‘হলি সি’ বাদে ইউরোপের বাকি ৪৩টি দেশই আক্রান্ত হয়েছে। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এই ৪৩টি দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৫৮ হাজার ৬২৮, যা মোট আক্রান্তের ৫২.৮৯ শতাংশ। এর সঙ্গে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রকে যোগ করলে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩৯, যা মোট আক্রান্তের প্রায় ৮৪ শতাংশ।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। গতকাল রবিবার শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত স্পেনে এক দিনে মৃত্যু হয়েছে ৬২৪ জনের। দেশটিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭৮ হাজার ৭৯৯ ও ছয় হাজার ৬০৬-তে। মাদ্রিদের হাসপাতালের রেডিওলজিস্ট পাবলো রদ্রিগেজ বলেন, ‘যে হারে রোগী বাড়ছে, রীতিমতো সুনামি বলা যেতে পারে।’
আক্রান্তের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইতালিতে (৯২ হাজার ৬৮৯) গতকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ১০ হাজার ৭৭৯। তবে আগের দিনের (৮৮৯) চেয়ে গতকাল (৭৫৬) সেখানে দৈনিক মৃতের সংখ্যা কিছুটা কমেছে। ইতালিতে ১৬ দিনের ‘লকডাউন’ চলছে; শেষ হবে আগামী ৩ এপ্রিল। তবে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর কথা ভাবছে ইতালি সরকার। দেশটির ‘সিভিল প্রটেকশন সার্ভিস’-এর প্রধান অ্যানজেলো বরেলি গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সব কিছু কি উন্মুক্ত করার সময় হয়েছে? আমার মনে এই সিদ্ধান্ত খুব সতর্কতার সঙ্গে নেওয়া উচিত।’ অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ‘করোনা বন্ড’ ছাড়ার প্রস্তাব দিয়েছে ফ্রান্স ও ইতালি। তবে জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে।
কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে শনিবার ফ্রান্সে ৩১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে দুই হাজার ৩১৪ জনের মৃত্যু হলো। মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৫৭৫। দেশটির প্রধানমন্ত্রী এদোয়ার্দ ফিলিপে সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই মাত্র শুরু। আগামী মাসের প্রথম দুই সপ্তাহ আমাদের জন্য আরো খারাপ সময় অপেক্ষা করছে।’
ইউরোপের আরেক দেশ জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৬৫৯-তে। মৃত্যু হয়েছে ৪৮২ জনের। মৃতের সংখ্যা এক হাজার ২০০ ছাড়িয়েছে যুক্তরাজ্যে। আক্রান্ত হয়েছে ১৯ হাজার ৫২২ জন। দেশের নাগরিকদের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ‘আমরা জানি, পরিস্থিতি ভালো হওয়ার আগে আরো খারাপের দিকে যাবে।’ করোনায় আক্রান্ত জনসন আরো লিখেছেন, ‘তবে আমরা সঠিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমরা সবাই যত বেশি নিয়ম মেনে চলব, তত কম জীবন হারাব।’
লকডাউনের বিপক্ষে ট্রাম্প
বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী, গতকাল রাত ১২টায় যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল এক লাখ ৩৩ হাজার ১৪৬। মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ৩৬৩। সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে নিউ ইয়র্কে, ৫৯ হাজার ৫১৩ জন। সেখানে মৃত্যু হয়েছে ৯৬৫ জনের। এর পরও সেখানে ‘লকডাউন’ আরোপের পক্ষে নন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শনিবার এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘কোয়ারেন্টিন এখনো জরুরি নয়।’ যদিও এর কয়েক ঘণ্টা আগে উল্টো প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। স্থানীয় রাজনীতিকদের অনেকেই ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, নিউ ইয়র্কের পরিস্থিতি শিগগিরই ইতালির মতো হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সব অঙ্গরাজ্যই ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে। নিউ ইয়র্কের পর সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে নিউ জার্সি (১১ হাজার ১২৪), ক্যালিফোর্নিয়া (পাঁচ হাজার ৭১৮) ও ওয়াশিংটন (চার হাজার ৩১০)।
এশিয়ার চিত্র
চীনে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ৫৪ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এদের সবাই বাইরের দেশ থেকে আসা। পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ৫৫ জনের মধ্যে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছিল; যাদের মধ্যে ৫৪ জনই বিদেশ থেকে আসা। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ইরানের পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। গতকাল দেশটিতে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে দুই হাজার ৯০১ জন। এ নিয়ে দেশটিতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল যথাক্রমে ৩৮ হাজার ৩০৯ এবং দুই হাজার ৬৪০। দক্ষিণ কোরিয়ায় নতুন ১০৫ জনসহ আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৮৩। মৃত্যু হয়েছে ১৫২ জনের। মালয়েশিয়ায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে দুই হাজার ৪৭০ ও ৩৫। পাশের দেশ ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ২৪-এ। মৃত্যু হয়েছে ২৭ জনের। পাকিস্তানে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা যথাক্রমে এক হাজার ৫২৬ ও ১৪। এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কায় গতকাল কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়েছে। ৬৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তি ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। শনিবার কলম্বোর একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তাঁর। দেশটিতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১১৭।
সার্বিক পরিস্থিতি
ওয়ার্ল্ডোমিটারের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল বাংলাদেশ সময় রাত ১১ পর্যন্ত বিশ্বের ১৯৯টি দেশ ও অঞ্চল কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত লাখ সাত হাজার ৬৮৪। মোট মৃত্যু হয়েছে ৩৩ হাজার ৫২৪ জনের। সুস্থ হয়েছে এক লাখ ৫০ হাজার ৭৩২ জন। চিকিৎসাধীন পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ৪২৮ জন। তাদের মধ্যে ২৫ হাজার ৪২২ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এ ছাড়া বিশ্বের প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে কভিডে আক্রান্ত হয়েছে গড়ে ৮৭ দশমিক ৭ জন। আর প্রতি ১০ লাখে মৃত্যু হয়েছে গড়ে ৪ দশমিক ১ জনের। অন্যদিকে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক মৃত্যুর হার ৪.৬৮ শতাংশ।
মোট আক্রান্তের ঘটনার ৮২ শতাংশই ঘটেছে ১০টি দেশে। দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, চীন, স্পেন, জার্মানি, ইরান, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডস। গতকাল রাত ৮ টা পর্যন্ত এই ১০টি দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ ৫৫ হাজার ৬০১। অর্থাৎ আক্রান্তদের বাকি ১৮ শতাংশ ১৮৯টি দেশ ও অঞ্চলের বাসিন্দা।
সূত্র : এএফপি, বিবিসি