ঋতুরাজ বসন্তের শেষ। এর পর প্রকৃতি তার সব রং নিয়ে হাজির হয়েছে। তবে বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সবই বর্ণহীন। বাঙালির সার্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখও আজ বিবর্ণ।

নতুন বছরের আবাহন। তাতে সাড়া দিয়ে নতুন পোশাক পরে প্রস্তুত হয় বাঙালি। শ্রেণি-পেশা-বয়স নির্বিশেষে সম্মিলন ঘটে। এতে প্রতিবছর বৈশাখের অনুষ্ঠানমঞ্চ মুখরিত হয়। তবে এবার সব জনমানবহীন। চারদিকে সুনসান নীরবতা। হাহাকার। এমন নিস্তরঙ্গ পহেলা বৈশাখ আর কখনো কেউ দেখেনি। তবু  সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টেছে ঘরে ঘরে। শুরু হয়েছে নতুন বছর ১৪২৭ সাল।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ কালের কণ্ঠকে বলেন, এ রকম বৈশাখ বাঙালি জীবনে আর আসেনি। জনমানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া, প্রাণস্পন্দনহীন এমন বৈশাখ আমার জীবনে আর দেখিনি। একাত্তর সালে আরেকবার এ রকম অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু তখন তো বৈশাখ উদযাপনের এতো ব্যাপকতা ছিল না। পহেলা বৈশাখ এসেছে, ছায়ানটের অনুষ্ঠানে যাবো না, মঙ্গলশোভা যাত্রায় হাটবো না, এটা চিন্তারও বাইরে ছিল। কিন্তু আজ বিশ্ববাস্তবতায় আজ এটাই সত্য। তবে সব কিছুকে জয় করে মানুষ আবার জেগে উঠবে এই বৈশাখে- এই প্রত্যাশা করি।

শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে বাতিল করা হয়েছে বর্ষবরণের সব আনুষ্ঠানিকতা। তবে টেলিভিশনসহ অন্যান্য ভার্চুয়াল মাধ্যমে নববর্ষের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানে মানুষকে অভয় বাণী শুনিয়েছেন বিশিষ্টজনরাও।

পহেলা বৈশাখের সূর্যোদয়ের সাথে রমনার বটমূলে প্রভাতী আয়োজনের মাধ্যমে বর্ষবরণের সকাল শুরু করা রাজধানীর মানুষের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। ১৯৬৭ সাল থেকে এ আয়োজন করে আসছে ছায়ানট। ১৯৭১ সাল মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া প্রতিবছরই এই পরিবেশনা হয়েছে। এবার সে অনুষ্ঠানটি হয়নি। সীমিত পরিসরে সকাল ৭টায় বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়েছে অন্যান্য বছরের অনুষ্ঠানগুলোর রেকর্ডের ভিত্তিতে। সেখানে প্রচারিত হয়েছে ছায়ানট সভাপতি সনজীদা খাতুনের বৈশাখী কথন।

সনজীদা খাতুন বলেন, ‘বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন নিয়তই মানুষে-মানুষে, মানুষে-প্রকৃতিতে অভিনব এক সংযোগ সৃষ্টি করে। নতুন দিনের আশা নিয়ে নববর্ষ ফিরে ফিরে আসে। কিন্তু আজ নতুন বছরের বার্তা যেন নতুন আশাকে ধূলিসাৎ করে দিতে চায়। জাতির জীবনে আজ ঘোর দুর্দিন, সমগ্র বিশ্বসমাজ আজ বিধ্বংসী মহামারিতে আক্রান্ত। উৎসবের দিন নয় আজ। বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করবার দিন। নিজে নিরাপদ থাকার পাশাপাশি সবাইকে নিরাপদ রাখার সময়। এই সর্বব্যাপী বিপদে আক্রান্ত বিরূপ বিশ্বে মানুষ একা হয়ে পড়েছে, আবার  বিশ্ববাসী আজ একই সংগ্রামের সহযাত্রী হয়ে মিলেমিশে একাকার।’

সনজীদা খাতুন আরো বলেন, ‘দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সভ্যতার যে সংকট দেখে রবীন্দ্রনাথ শিহরিত হয়েছিলেন, আজকের সংকট তার চেয়েও বহুবিস্তৃত। পৃথিবীর গভীর-গভীরতর অসুখে আমরা এ-ও জানি, বিপুল ধ্বংসলীলা আসন্ন হলেও, সেকথাই একমাত্র সত্য নয়। মানবকল্যাণের জন্য আমরা ঐকান্তিক চেষ্টা এবং ঐকান্তিক মিলনের শপথে ঐক্যবদ্ধ হবো আজ। মহাবিশ্বের প্রতিটি মানুষ পরস্পর অদৃশ্য ঐক্যসূত্রে বাঁধা। সভ্যতা, মানবতা ও প্রকৃতির নিবিড় মেলবন্ধনে আমরা আস্থা রাখি। কামনা করি বিচ্ছিন্নতা ও বন্দিত্ব পেরিয়ে নতুন উপলব্ধিতে নতুন বিশ্ব গড়বার প্রেরণা সঞ্চারিত হবে সবার মধ্যে, মহা-সংকট বয়ে আনবে মহা-পরিবর্তন, কেননা, মানুষই পারে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আলোর পথের অভিযাত্রী হতে। পৃথিবীর ঘরে ঘরে যত মানুষ আছে, সবার জন্যে শুভকামনা জানাই আমরা। জয় আমাদের হবেই। সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের সেই কথা ফিরে উচ্চারণ করব আজ-‘জয় হোক মানুষের, ওই চিরজীবিতের’। শুভ নববর্ষ।’

ছায়ানটের অনুষ্ঠান শেষ হয় সকাল সাড়ে ৯টার দিকে। এর পর শুরু হয় বাঙালির বর্ষবরণের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। মুখোশসহ নানা শিল্পকর্মে নিজস্ব সংস্কৃতির বার্তায় আঁধার তাড়ানোর মঙ্গল আয়োজনে ভিড় নামতো সর্বস্তরের মানুষের। এবার সে আয়োজনও হয়নি। তবে রীতি অনুসারে প্রতিবছরের মতো এবারো বাংলা বর্ষবরণের পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে। এটি ভার্চুয়ালি প্রকাশিত হয়েছে।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়’- বাণীকে এবারের বর্ষবরণের মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। পোস্টারে মূল প্রতিপাদ্যের পাশাপাশি এবার এর ব্যাখ্যাও যুক্ত করা হয়েছে। এজন্য আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্যা সি’  থেকে ‘মানুষকে ধ্বংস করা যায় কিন্তু পরাজিত করা যায় না’ -এ লাইন ব্যবহার করা হয়েছে।

পহেলা বৈশাখে রাজধানীর গলি থেকে রাজপথ পরিণত হতো লোকজ পণ্যের বাড়োয়ারি মেলায়। এবার সে রকম কিছুই  নেই। তবে মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবার নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন সবাই।

মহামারির প্রাদুর্ভাবে বর্ষবরণের আয়োজন নিজ নিজ ঘরেই করার আহ্বান এসেছে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার কাছ থেকে।  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী ডিজিটাল পদ্ধতিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন করে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে সরকারি-বেসরকারি সব টেলিভিশনে একযোগে সম্প্রচার করা হয় বৈশাখের অনুষ্ঠান।

পহেলা বৈশাখে খোঁপায় তাজা ফুল আর রঙিন শাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে বৈশাখী উৎসবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী দিল আফরোজ খুশি। অন্যান্য বছরে নববর্ষকে কেন্দ্র করে অনেক প্রস্তুতি থাকলেও এবার সব কিছু ফিকে লাগছে তার।

খুশি বলেন, ‘শেষ সময়টায় এসে প্রতিবছরই চুড়ি, ফুল- এসব কেনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। চারুকলায় গিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি দেখতাম। চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন করতাম বন্ধুরা মিলে। এবার কোনো কিছুই নেই। চারদিকে শুধু করোনাভাইরাসের ভয় আর আতঙ্ক। আশা করি, আগামী বৈশাখে এমন আতঙ্ক আর থাকবে না। মানুষ সব কিছু জয় করবে।’