করোনাভাইরাসে সরকারি সাধারণ ছুটির এক সপ্তাহ পর থেকেই দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে পণ্য উঠানামা ও সরবরাহে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল। মূলত বন্দর থেকে পণ্য সরবরাহ এক তৃতীয়াংশে নেমে আসায় ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ স্টোর রেন্ট মাফ করেও কোনো সুফল পায়নি। এরপর বহির্নোঙর থেকে জাহাজ আসা কমিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল নেয়; পরে জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামানোর ক্ষেত্রে রেশনিং পদ্ধতি চালু করে অর্থ্যাৎ বন্দরের ভিতর যে পরিমাণ স্থান খালি হবে শুধু সেই পরিমাণ কন্টেইনার জাহাজ থেকে নামনো হয়। কিন্তু তাতেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি; আর ভেস্তে যায় বন্দরের নেওয়া সব উদ্যোগ।

পরিস্থিতি সামাল দিতে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিদের্শে লকডাউনের মধ্যেও সর্বশেষ গত ১৪ এপ্রিল সার্কিট হাউজে বন্দর কর্তৃপক্ষ, বন্দর ব্যবহারকারী, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের উপস্থিতিতে জরুরি সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেখানে কোনো সমাধান না আসায় বন্দর পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। এই অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে নতুন বিপদে পড়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দরের ভিতর বিভিন্ন ইয়ার্ডে কন্টেইনার রাখা যায় সর্বোচ্চ ৪৯ হাজার একক; অথচ গতকাল বৃহস্পতিবার সেই ধারনক্ষমতা উপচে গিয়ে সাড়ে ৪৯ হাজার এককে উন্নীত হয়েছে অর্থ্যাৎ ৫শ একক বাড়তি কন্টেইনার রাখা হয়েছে। অর্থ্যাৎ কোথাও কন্টেইনার রাখা হয়েছে একটির ওপর একটি করে তিন থেকে চার স্তর আবার গাড়ি চলাচলের পথেও রাখা হয়েছে পণ্যভর্তি কন্টেইনার। অবস্থা এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার।

উল্লেখ্য, দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে দেশের মোট আমদানির ৮২ শতাংশ আসে; আর রপ্তানি পণ্যের ৯১ শতাংশই যায় এই বন্দর দিয়ে। সুতরাং আমদানি-রপ্তানির এই গতিতে সামান্য নেতিবাচক প্রভাব পড়লে তা পুরো দেশের অর্থনীতির ওপরই বড় প্রভাব পড়ে।

বন্দর কর্মকর্তারা বলছেন, কন্টেইনার ডেলিভারি স্বাভাবিক না করা পর্যন্ত ওই অচলাবস্থার উন্নতি সম্ভব নয়। তাই নতুন পদক্ষেপ হিসেবে বন্দরের ভিতর থেকে পণ্যভর্তি কন্টেইনার পাশে অবস্থিত বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোগুলোতে স্থানান্তর করতে।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নতুন চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এম আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১৫ থেকে ২০ হাজার একক পণ্যভর্তি কন্টেইনার বন্দর ইয়ার্ড থেকে সরিয়ে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে নেওয়া হবে। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমোদন প্রয়োজন, আমার ১৫ এপ্রিল সেই প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি; অনুমোদনের অপেক্ষায় আছি।

তিনি বলেন, কন্টেইনার স্থানান্তর করা গেলে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে; জাহাজ থেকে বাড়তি কন্টেইনার নামানো যাবে। বেশি জাহাজও ভিড়ানো যাবে।

বন্দর চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলছেন, ‘কন্টেইনার ডেলিভারি বাড়াতে প্রথমেই ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। সরবরাহ বাড়াতে বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয় ও করণীয় নির্ধারনে দু একদিনের মধ্যে শীর্ষ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত আসবে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় নিয়মিত এখন বিষয়টি তদারকি করছেন। আশা করছি পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

জানা গেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য উঠানামা-সরবরাহ কাজ ২৪ ঘণ্টাই সচল ছিল। এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বন্দর ব্যবহারকারী বেশ কটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম খোলা রাখা হয়েছে; খোলা ছিল শুল্কায়নের সাথে জড়িত চট্টগ্রাম কাস্টমসের কার্যক্রমও। যদিও কাস্টমসের কার্যক্রম প্রথম দিকে একেবারে সীমিত থাকায় পণ্য শুল্কায়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অবশ্য সরকারি পরবর্তী নির্দেশে কাস্টমসের কাজও সচল হয়। দিনে তিন ঘণ্টা খোলা রাখা হয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যক্রম। কিন্তু বন্দর ব্যবহারকারী সরকারি-বেসরকারি সবগুলো সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে সমন্বয় না থাকায় বন্দর থেকে পণ্য সরবরাহ কমে যায়। আগে দিনে যেখানে চার থেকে সাড়ে হাজার একক পণ্যভর্তি কন্টেইনার বন্দর থেকে সরবরাহ নিতেন ব্যবসায়ীরা সাধারণ ছুটির পর সেই সরবরাহ ব্যবস্থায় ধ্বস নেমেছে। এখন দিনে সরবরাহ নিচ্ছেন কেবল এক তৃতীয়াংশ কন্টেইনার। ফলে যেই পরিমাণ কন্টেইনার জাহাজ থেকে নামছে সেই পরিমাণ কন্টেইনার বন্দর থেকে সরবরাহ না নেওয়ায় কন্টেইনার জমে গিয়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়।

চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম মনে করেন, বন্দরের ভিতর আটকে থাকা ভোগ্য ও খাদ্যপণ্য বাছাই করে দ্রুত ছাড়ের ব্যবস্থা নিলে দেশের পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক থাকবে; একইসাথে বন্দরের ভিতরও কন্টেইনার রাখার স্থান বাড়বে। তবে কারখানা না খুললে শিল্পের কাঁচামাল কিভাবে তাদের গুদামে নিবেন তা বুঝে উঠতে পারছি না। যদি পতেঙ্গা সাগর উপকূলে বে টার্মিনাল সচল হতো তাহলে বিপুল পণ্য রাখার একটা ভালো বিকল্প থাকতো। ব্যবসায়ীরাও টেনশনে থাকতেন না।

হিসাব কষে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরে আটকে পড়া সাড়ে ৪৯ হাজার একক কন্টেইনারের মধ্যে সবচে বেশি ১৪ হাজার একক কন্টেইনার হচ্ছে তৈরি পোশাক কারখানার কাঁচামাল; দ্বিতীয় স্থানে আছে বিভিন্ন শিল্প কারখানার কাঁচামাল। বাকিটা হচ্ছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কন্টেইনারে আনা বিদেশি ফল, আদা, রসুন, পেঁয়াজ ও সামুদ্রিক মাছ।

গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, এমন না যে আমরা ইচ্ছে করেই বন্দরে ওই পণ্য রেখে দিয়েছি। পরিস্থিতির কারণেই আমরা রাখতে বাধ্য হয়েছি। অবস্থা এমনও হয়েছে পণ্যের দামের প্রায় সমাণ বন্দর মাশুল চলে এসেছে। শেষপর্যন্ত এই পণ্য ডেমারেজ দিয়ে হলেও আমাদের ছাড় করতে হবে। তবে কারখানা খোলার আগ পর্যন্ত দ্রুত পণ্যগুলো নিজেদের গুদামে নিবেন না। এরপরও আমরা বিজিএমইএ সদস্যদেরকে ডেমারেজ এড়াতে দ্রুত পণ্য ছাড় করে নিজেদের গুদামে রাখার তাগাদা দিয়েছি। তিন সপ্তাহে আমি ছয়বার তাগাদা পত্র দিয়েছি।