করোনার ঝুঁকি এড়াতে জনসাধারণকে মাস্ক ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রচারণা চালাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই ভাইরাসের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে গ্লাভসও। এতে জনসাধারণ ‘ভাইরাসমুক্ত’ থাকতে মাস্ক-গ্লাভসের ব্যবহার বাড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু যেখানে-সেখানে এসব মেডিক্যাল সরঞ্জাম ফেলার কারণে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে ‘স্বাস্থ্যঝুঁকি’ও।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এসডো’র মে মাসে প্রকাশিত এক জরিপ বলছে, এপ্রিলেই প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি সার্জিক্যাল ফেস মাস্ক ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩১৪ টন সার্জিক্যাল হ্যান্ড গ্লাভসের বর্জ্য উৎপাদিত হয়েছে। এছাড়া, পলিথিন হ্যান্ড গ্লাভস ৬০২ টন, সার্জিক্যাল মাস্ক ৪৪৭ টন, পলিথিন ব্যাগ ৪৪৩ টন ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল থেকে ২৭০ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে।
সালাউদ্দিন নামে এক বাড়িওয়ালা বলেন, ‘পুরো শহরকে অনেকে ডাস্টবিন বানিয়ে ফেলেছেন। যেখানে সেখানে এসব মাস্ক, গ্লাভস ফেলে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কোনো ধরনের সচেতনতা নেই। সিটি করপোরেশনের উচিত, এসব মানুষের এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে শাস্তির আওতায় আনা।’
নাদিম নামে এক তরুণ বলেন, ‘রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দেখি গ্লাভস ছিঁড়ে যাওয়ায় একজন তা ফেলে যাচ্ছেন। অনেকে এভাবে যেখানে সেখানে মাস্ক, গ্লাভস ফেলে যান। এটা ঠিক না। এসব মেডিক্যাল সরঞ্জামে ভাইরাস থাকতে পারে। এগুলো আমাদের সবার ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
করোনা নিয়ে পুরোপুরি ধারণা না থাকলেও মোটামুটি ‘সচেতন’ দেখা গেলো পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. নয়নকে। তিনি বলেন, ‘শুনেছি এসব মাস্ক, গ্লাভসে নাকি ভাইরাস থাকে। সবাই যদি একটু সচেতনভাবে এগুলো ফেলতো, তাহলে করোনার ঝুঁকি কিছুটা হলেও কমতো।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম রফিক বলেন, ‘এসব বর্জ্য দিন দিন বাড়ছে। এগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। আমরা এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনকে বরাবরই সচেতন করে আসছি। এর সম্পূর্ণ প্রটেকটিভ ব্যবস্থা না নিলে আমাদের পরিবেশের জন্য একসময় চরম হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, ‘ঢাকাতেই প্রতিদিন ৫৬ টন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। যার মধ্যে ক্ষতিকর ১০ টন। স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে এই মহামারীর সময় ক্ষতিকর বর্জ্যগুলো পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সঙ্গে সংগ্রহ করতে হবে। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (মহাপরিচালকের দায়িত্বপ্রাপ্ত) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘এ জাতীয় বর্জ্য সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। আক্রান্ত ব্যক্তির মাস্ক, গ্লাভস তো আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। আসলে আমাদের অসচেতনতার কারণে এটি হচ্ছে। শহরের অলি-গলির কর্তাব্যক্তি, বাসাবাড়ির মালিকদের এক্ষেত্রে আরও ভূমিকা রাখতে হবে।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান মামুন বলেন, ‘নির্দেশনা দেওয়া আছে, যারা এসব মেডিক্যাল সরঞ্জাম ব্যবহার করবেন, পরে সেগুলো যেন নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলেন। সেগুলো যেন ঢাকনাযুক্ত অবস্থায় থাকে। এজন্য আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। যারা এসব বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলছেন ,তারা আরেকজনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। একই সঙ্গে আমাদের যারা বর্জ্য অপসারণের দায়িত্বে আছেন তাদেরও ঝুঁকিতে ফেলছেন। এক্ষেত্রে সচেতনতার বিকল্প নেই।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাসনাত মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘অসচেতনভাবে অনেকে মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই রাস্তায় ফেলে যান। এটি কোনোভাবে কাম্য নয়। করোনা সংক্রমণ এড়াতে মাস্ক ব্যবহার করলে বাসায় গিয়ে হাত ধোয়ার পর সেটি খুলে ময়লার ঝুড়ি কিংবা পৃথক বিনে রাখতে হবে। যখন আমাদের পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাসা থেকে ময়লা আনতে যাবেন, তখন সেটি তার কাছে দিতে হবে। কিভাবে মাস্ক ডিসপোস করতে হবে, সে বিষয়ে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়েছি। তারপরও রাস্তায় মাস্ক-গ্লাভস পড়ে থাকলে সেগুলো আমাদের কর্মীরা অপসারণ করছেন।’
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান ছিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে ব্যবহৃত মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই ফেলার জন্য একটি করে কন্টেইনার স্থাপনের প্রস্তাব করেছি। এটি শিগগিরই বসানো হবে। আমাদের যেসব পরিচ্ছন্নতাকর্মী বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করেন, তাদের কাছে এসব বর্জ্য দেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’