মাত্র ২১ সেকেন্ডেই বড় একটি লঞ্চ রীতিমতো চাপা দিয়ে ছোট একটি লঞ্চকে ডুবিয়ে দিয়েছে। মর্নিং বার্ড নামের ছোট লঞ্চটিতে যাত্রী ছিল ৮০ জনের মতো। তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৩২ জনই লাশ হয়ে গেছে। শত শত লঞ্চ-নৌকা যেখানে ভিড় জমিয়ে থাকে, রাজধানীর সদরঘাটের কাছে শ্যামবাজারসংলগ্ন বুড়িগঙ্গায় ঘটেছে এই মর্মান্তিক ঘটনা। গতকাল সোমবার সকাল ৯টার দিকে অনেকের চোখের সামনে ময়ূর-২ নামের বড় লঞ্চটির ধাক্কায় মর্নিং বার্ড তলিয়ে গেলে নৌকায় ছুটে যায় দুই পারের মানুষ। এরপর এসে তাদের সঙ্গে যোগ দেন উদ্ধারকর্মীরা। মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে সদরঘাটে এসে নোঙর করতে যাচ্ছিল মর্নিং বার্ড। ময়ূর-২ লঞ্চটিও চাঁদপুর থেকে সদরঘাটে এসে যাত্রী নামিয়ে ভিন্ন স্থানে নোঙর করতে যাচ্ছিল। নিহতদের সবাই মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা। তাদের বাড়ি বাড়ি এখন মাতম। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ১০-১২ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করেছে স্বজনরা। উদ্ধারকর্মীরা ২৫ জনকে জীবিত উদ্ধারের দাবি করেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শী, উদ্ধারকারী ও লঞ্চের জীবিত যাত্রীরা জানান, ময়ূর-২ লঞ্চটি ঘাটের দিকে আসা মর্নিং বার্ডকে দেখেও গতি কমায়নি। মর্নিং বার্ডও গতিপথ থেকে ঘুরে যেতে পারেনি। দুই লঞ্চের অসাবধানতা থাকলেও ময়ূর-২ লঞ্চটি বেপরোয়া চালানোর কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা যেমন বলছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেও অনেকেরই তাই ধারণা। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ), ফায়ার সার্ভিস, কোস্ট গার্ড, নৌ পুলিশ ও নৌবাহিনীর সদস্যরা ডুবুরিদল নিয়ে দিনভর অভিযান চালিয়ে মর্নিং বার্ডের ৩২ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করেন। তাদের মধ্যে তিনটি শিশু, আটজন নারী এবং ২১ জন পুরুষ। তাদের সবার বাড়িই মুন্সীগঞ্জে। গত রাত ১০টা পর্যন্ত ৩২ জনের লাশ শনাক্ত করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ৩২ লাশের মধ্যে একটি ঢাকার দোহারের, মুন্সীগঞ্জ সদরের ১৯টি, টঙ্গিবাড়ীর ৯টি, সিরাজদিখানের একটি এবং শ্রীনগরের একটি।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ডুবে থাকা লঞ্চটির অবস্থান শনাক্ত করা গেছে। উদ্ধারের জন্য ‘প্রত্যয়’ নামের উদ্ধারকারী জাহাজ নিয়ে আসার চেষ্টা করা হলেও উচ্চতার কারণে সেটি বুড়িগঙ্গা সেতুর কাছে আটকে যায়। বিকেল থেকে মর্নিং বার্ডের ভেতরে বেলুনে গ্যাস দিয়ে ভাসানোর চেষ্টা শুরু করেন উদ্ধারকারীরা। লঞ্চের ভেতরে এখনো দু-একটি মৃতদেহ থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাতভর অভিযান অব্যাহত ছিল। ঘটনার তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়।

নিহত-নিখোঁজদের স্বজনদের বিলাপে বুড়িগঙ্গা তীর ও মিটফোর্ড হাসপাতালের মর্গ এলাকার আকাশ ভারী হয়ে ওঠে। স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিহতদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। অনেকেই জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় আসছিল। কেউ আসছিল চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় কাজে। করোনার দুর্যোগের মধ্যে এই মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিটি পরিবারে মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে। গতকাল জেলা প্রশাসন ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিহতদের লাশ দাফনের জন্য পরিবারকে ৩০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে ঘটনার পরই ময়ূর-২ লঞ্চটি জব্দ করা হয়েছে। তবে এই লঞ্চের মাস্টার বাশার মোল্লা, সহকারী জাকির হোসেন খলিফা ও শিপন হাওলাদার পলাতক রয়েছেন। আশিক (১৮) নামের এক ইঞ্জিন বয় নিখোঁজ আছেন বলে দাবি করেছেন তাঁর মা পপি বেগম।

দুপুরে ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে গিয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহ্মুদ চৌধুরী বলেন, ‘এটি কোনো দূর্ঘটনা নয়, বিষয়টি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে মনে হয়েছে। মৃতদের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা করে দেওয়ার পাশাপাশি লাশ দাফনের জন্য ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনার জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ জানা গেছে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) রফিকুল ইসলাম খানকে আহ্বায়ক এবং বিআইডাব্লিউটিএর পরিচালক (নৌ নিরাপত্তা) রফিকুল ইসলামকে সদস্যসচিব করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে ফায়ার সার্ভিস ও নৌ পুলিশের প্রতিনিধিও আছেন।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ‘এ পর্যন্ত ৩২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজদের উদ্ধারে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। আমাদের ১৪ জন ডুবুরি কাজ করছেন। আর তেমন নিখোঁজ বা ডুবে বেশি মানুষ নেই বলে মনে হচ্ছে। এর পরও লঞ্চটির ভেতরে মৃতদেহ থাকলে তা বের করার চেষ্টা করা হবে। যদি লঞ্চটিকে একটু ভাসানো যায়, তাহলে কাজটি সহজ হবে।’

বিআইডাব্লিউটিএর পরিবহন পরিদর্শক মো. সেলিম জানান, এমভি মর্নিং বার্ড নামের লঞ্চটি মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টি থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাটের দিকে আসছিল। সকাল সোয়া ৯টার দিকে শ্যামবাজারের কাছে চাঁদপুর থেকে আসা ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় সেটি ডুবে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ময়ূর-২ ভোর সাড়ে ৪টার দিকে লালকুঠি ঘাটে যাত্রী নামিয়ে সদরঘাটের চাঁদপুর ঘাটে গিয়ে নোঙর করার জন্য ব্যাগার (ব্যাক গিয়ারে) ঘুরছিল। ওই সময় পেছনে থাকা এমভি মর্নিং বার্ডের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, সকাল ৯টা ১৩ মিনিটে ঘোরানোর জন্য যাওয়ার সময় মাত্র ২১ সেকেন্ডে ময়ূর-২-এর সামনের অংশের নিচে চাপা পড়ে মর্নিং বার্ড।

লঞ্চ থেকে সাঁতরে তীরে ওঠা বাবুল মিয়া নামের এক যাত্রী বলেন, ‘আমি লঞ্চের ওপরে ছিলাম। প্রশ্রাব করার জন্য বাথরুমে যাই। হঠাৎ একটি শব্দ শুনতে পাই। বাথরুম থেকে বের হয়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই লঞ্চ ডুবতে শুরু করলে আমি পানিতে ঝাঁপ দিয়ে কোনো রকমে প্রাণ বাঁচাই।’ বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন বাবুল। তাঁর ভাষ্য মতে, লঞ্চে যাত্রী ছিল ৮০ জনের মতো। ওপরে থাকা ২০-৩০ জন তীরে উঠতে পেরেছে। বাকিরা তলিয়ে গেছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, যে স্থানে লঞ্চটি ডুবে যায় তার পাশে লঞ্চ দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে ফায়ার সার্ভিস, বিআইডাব্লিউটিএ, নৌ পুলিশ, কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধারকাজ করেন। ডুবুরিদলের সহায়তায় পানির নিচ থেকে ৩২টি মৃতদেহ উদ্ধারের পর বিকেল সাড়ে ৩টার মধ্যে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়। তিন দফায় পাঠানো লাশগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। এ সময় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দাফনের জন্য দেওয়া হয়। নদীর তীর ও হাসপাতালের মর্গের সামনে স্বজনরা ভিড় করে বিলাপ করতে থাকে। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা যাদের লাশ উদ্ধার করেছেন, তাদের মধ্যে যমুনা ব্যাংকের ইসলামপুর শাখার কর্মচারী সুমন তালুকদারকে শনাক্ত করেন তাঁর বড় ভাই নয়ন তালুকদার। তিনি জানান, তাঁদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিমে। প্রতিদিন বাড়ি থেকে এসে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে অফিস করতেন সুমন। প্রতিদিনের মতো সকাল সাড়ে ৭টার দিকে লঞ্চে উঠে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন এক সন্তানের বাবা সুমন। পরে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে এবং তাঁর ফোন বন্ধ পেয়ে সদরঘাটে ছুটে আসেন তাঁর ভাই।

লঞ্চযাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ময়ূর-২ লঞ্চটি নতুন স্থানে নোঙর করার সময় এর মাস্টার ও সহকারীরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি। এই লঞ্চের মাস্টার আবুল বাশার, তাঁর সহকারী জাকির হোসেন খলিফা ও শিপন হাওলাদারের হদিস মেলেনি। আবুল বাশার লঞ্চ থেকে লাফিয়ে তীরে উঠে গেছেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ শাহজামান বলেন, ‘আমরা এখনো কাজ শেষ করতে পারি নাই। মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে দুর্ঘটনাকারী জাহাজ ময়ূরী-২ পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। কোনো গ্রেপ্তার নাই।’

নিহত যারা : গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত যে ৩০ জনের লাশ হস্তান্তর করা হয় তাঁরা হলেন সত্যরঞ্জন (৬৫), মিজানুর (৩২), সাইদুল (৬২), সুফিয়া বেগম (৫০), মনিরুজ্জামান (৪২), সুবর্ণা আক্তার (২৮), মুক্তা (১২), গোলাম হোসেন ভূইয়া (৫০), আবজাল শেখ (৪৮), বিউটি (৩৮), ময়না (৩৫), আমির হোসেন (৫৫), মো. নাইম (১৭), শাহাদাৎ (৪৪), শামীম বেপারী (৪৭), মিল্লাত (৩৫), আবু তাহের (৫৮), দিদার হোসেন (৪৫), হাফেজা খাতুন (৩৮), সুমন তালুকদার (৩৫), আয়শা বেগম (৩৫), হাসিনা রহমান (৪০), আলম বেপারী (৩৮), মোসা. মারুফা (২৮), শহিদুল হোসেন (৪১), তালহা (২), ইসমাইল শরীফ (৩৫), তামিম ও সাইদুল ইসলাম (৪২)।

১৩ ঘণ্টা পর একজনকে জীবিত উদ্ধার : লঞ্চডুবির প্রায় ১৩ ঘণ্টা পর রাত ১০টার দিকে এক ব্যক্তিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। নদীতে ভেসে ওঠার পর কোস্ট গার্ডের কর্মীরা তাঁকে তুলে নেন। উদ্ধার করার পর তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁর জ্ঞান ফিরে আসে। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তির নাম সুমন বেপারী (৩৫)। মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী থানার আব্দুল্লাহপুরের সজল বেপারীর ছেলে সুমন বাদামতলী এলাকার ফল ব্যবসায়ী বলে তাত্ক্ষণিকভাবে জানা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের ডেপুটি ডিরেক্টর দেবাশিষ বর্ধন বলেন, ‘আমরা ধারণা করছি, উদ্ধার হওয়া এই ব্যক্তি সম্ভবত ইঞ্জিনরুমে ছিলেন। সাধারণত ইঞ্জিনরুম এয়ারটাইট হওয়ার কারণে সেখানে পানি প্রবেশ করে না। ১০টা ১০ মিনিটের দিকে কুশন পদ্ধতি ব্যবহার করে জাহাজ ভাসানোর চেষ্টা করা হলে সম্ভবত ইঞ্জিনরুম খুলে যায়। সে সময় তিনি বের হয়ে আসেন।’