দুর্বার সাকিব দুর্বার বাংলাদেশ

সাউদাম্পটনের মন্থর উইকেটে বাংলাদেশের যত ভয় ছিল আফগানিস্তানের স্পিন আক্রমণ নিয়ে। একই ভেন্যুতে আগের ম্যাচে যারা ভারতকে বেঁধে ফেলেছিল মাত্র ২২৪ রানে। কিন্তু বাংলাদেশকে সেভাবে চোখ রাঙাতে পারলেন না আফগান স্পিনাররা।

উল্টো ব্যাটে-বলে সত্যিকারের ত্রাস ছড়ালেন সাকিব আল হাসান। ইতিহাস গড়া অলরাউন্ড নৈপুণ্যে একের পর এক রেকর্ডের পাতা রাঙিয়ে সাকিব একাই গুঁড়িয়ে দিলেন আফগানিস্তানকে।

বিশ্বকাপ মঞ্চে সোমবার আরেকটি সাকিবময় ম্যাচে আফগানিস্তানকে ৬২ রানে হারিয়ে সেমিফাইনালের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখল দুর্বার বাংলাদেশ। সাত ম্যাচে এটি টাইগারদের তৃতীয় জয়।

সাউদাম্পটনের রোজ বোলে কাল টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে মুশফিকুর রহিম (৮৩) ও সাকিবের (৫১) লড়াকু ফিফটিতে সাত উইকেটে ২৬২ রানের চ্যালেঞ্জিং স্কোর গড়েছিল বাংলাদেশ।

জবাবে বোলার সাকিবের স্পিন-বিষে নীল হয়ে ১৮ বল বাকি থাকতেই ২০০ রানে গুটিয়ে যায় আফগানিস্তান। ব্যাট হাতে আসরে পঞ্চম পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসের পর ক্যারিয়ারসেরা বোলিংয়ে ২৯ রানে পাঁচ উইকেট নিয়ে দলকে প্রত্যাশিত জয় এনে দেয়ার পাশাপাশি সাকিব গড়েছেন এক অনন্য ইতিহাস।

প্রথমে গড়েন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপে এক হাজার রানের মাইলফলক ছোঁয়ার কীর্তি। পরের কীর্তিটা বিশ্বকাপ ইতিহাসেই অদ্বিতীয়। এক হাজার রান ও ৩০ উইকেটের অনন্য ডাবল।

বিশ্বকাপে আর কোনো অলরাউন্ডারই পা রাখতে পারেননি এই চূড়ায়। চার আসর মিলিয়ে বিশ্বকাপে ১০১৬ রান করার পাশাপাশি সাকিব নিয়েছেন ৩৩ উইকেট। সাকিবময় জয়ে সাত ম্যাচে সাত পয়েন্ট নিয়ে শ্রীলংকাকে (৬) টপকে পয়েন্ট টেবিলের পাঁচে উঠে এসেছে বাংলাদেশ।

চারে থাকা ইংল্যান্ডের সঙ্গে ব্যবধান মাত্র এক পয়েন্ট। তবে সেমির পথ এখনও যথেষ্ট বন্ধুর। শেষ চারের আশা বাঁচিয়ে রাখতে ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ দু’ম্যাচেও জিততে হবে বাংলাদেশকে।

কাজটা কঠিন হলেও একের পর এক বাধা পেরিয়ে যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন মাশরাফিরা, তাতে স্বপ্ন দেখাই যায়। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আক্ষেপ জাগানিয়া হারের পর আফগানিস্তানকে উড়িয়ে দিয়ে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়াল টাইগাররা।

ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকেও মাটিতে নামানোর হুংকার দিয়েছিল আফগানরা। কিন্তু গত বিশ্বকাপের মতো এবারও বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি তারা।

২৬৩ রানের লক্ষ্য তাড়ায় আফগানিস্তানের উদ্বোধনী জুটি বেশ জমে উঠেছিল। পেসাররা সুবিধা করতে না পারায় ব্রেকথ্রুর জন্য শেষ পর্যন্ত আস্তিন থেকে তুরুপের তাস বের করতে হয় অধিনায়ক মাশরাফি মুর্তজাকে।

১১তম ওভারে আক্রমণে এসেই রহমত শাহকে ফিরিয়ে ৪৯ রানের জুটি ভাঙেন সাকিব। দ্বিতীয় সাফল্য আসে আরেক স্পিনার মোসাদ্দেক হোসেনের হাত ধরে। হাশমতউল্লাহ শাহিদিকে স্টাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন মোসাদ্দেক।

পরের গল্পটা শুধুই সাকিবময়। ২৯তম ওভারে এক বলের ব্যবধানে গুলবাদিন নাইব ও মোহাম্মদ নবীকে ফিরিয়ে আফগান ব্যাটিংয়ের কোমর ভেঙে দেন সাকিব। ৩৩তম ওভারে সাকিবের চতুর্থ শিকার হয়ে ফেরেন আসগর আফগান।

এরপর নাজিবউল্লাহ জাদরানকে ফিরিয়ে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে পাঁচ উইকেটের স্বাদ পান সাকিব। ওয়ানডেতে এটি তার দ্বিতীয় পাঁচ উইকেট। বিশ্বকাপে সাকিবের আগে এক ম্যাচে ফিফটি ও পাঁচ উইকেটের কীর্তি ছিল শুধু ভারতের যুবরাজ সিংয়ের।

ছয় ইনিংসে সর্বোচ্চ ৪৭৬ রান করার পাশাপাশি ১০ উইকেট নিয়ে সাকিবই এই বিশ্বকাপের উজ্জ্বলতম মুখ। ম্যাচসেরা সাকিবের তোপের মুখে আফগানিস্তানের কেউ ফিফটির দেখা পাননি।

সর্বোচ্চ ৪৯* রান করেন সামিউল্লাহ শেনওয়ারি। এছাড়া অধিনায়ক নাইবের ব্যাট থেকে আসে ৪৭ রান। বাংলাদেশের পক্ষে সাকিবের পাঁচ উইকেটের পাশাপাশি মোস্তাফিজুর দুটি এবং সাইফউদ্দিন ও মোসাদ্দেক নেন একটি করে উইকেট।

এর আগে মন্থর উইকেটে রানের জন্য কিছুটা সংগ্রাম করতে হলেও আফগান বোলিং বেশ ভালোভাবেই সামলেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। মুশফিক ও সাকিবের চওড়া ব্যাটে মিলেছিল ২৬২ রানের লড়াকু পুঁজি।

আফগানদের জন্য সেই রানটাকেই হিমালয় বানিয়ে ফেলেন বোলার সাকিব। বাঁচা-মরার ম্যাচে বাংলাদেশের সংগ্রহ আরও বড় হতে পারত। সেটা হয়নি শুরুতেই আম্পায়ারের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্তের কারণে।

আফগান স্পিন সামলাতে বাঁ-হাতি, ডান-হাতি কম্বিনেশন কার্যকর হতে পারে- এমন ভাবনা থেকে কাল তামিম ইকবালের সঙ্গে সৌম্য সরকারের বদলে ওপেনিংয়ে নামানো হয়েছিল লিটন দাসকে। ভালোই খেলছিলেন লিটন।

কিন্তু ১৭ বলে ১৬ রান করে আম্পায়ারের প্রশ্নবিদ্ধ সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে ফিরতে হয় তাকে। মুজিব উর রেহমানের করা পঞ্চম ওভারের দ্বিতীয় বলে লিটনের শট ডাইভ দিয়ে লুফে নেন হাশমতউল্লাহ।

আউটের ব্যাপারে নিশ্চিত না হওয়ায় তৃতীয় আম্পায়ারের দ্বারস্থ হন মাঠের আম্পায়ার রিচার্ড ক্যাটেলবরো। রিপ্লে দেখে মনে হয়েছে, বল তালুবন্দি হওয়ার আগে মাটি ছুঁয়েছিল।

কিন্তু ক্যাটেলবরো আগেই আউটের সফট সিগন্যাল দিয়ে রাখায় তৃতীয় আম্পায়ার আলিম দারও আউট দিয়ে দেন। পরে সাকিবের বিপক্ষেও আউটের ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন ক্যাটেলবরো।

যে যাত্রায় রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান সাকিব। পুরো ম্যাচেই কাল বেশ কয়েকটি ফিফটি-ফিফটি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিপক্ষে গেছে। তাতে অবশ্য দমে যাননি বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।

ফর্মের তুঙ্গে থাকা সাকিব ও মুশফিকের ব্যাট ঠিকই হেসেছে। এই বিশ্বকাপে দুই সেঞ্চুরি ও তিন ফিফটিতে ছয় ইনিংসে সাকিব একাই করেছেন ৪৭৬ রান। এছাড়া এক সেঞ্চুরি ও দুই ফিফটিতে ৩২৭ রান নিয়ে মুশফিক উঠে এসেছেন ছয়ে।

আগের ম্যাচের সেঞ্চুরিয়ান মুশফিক কালও ছিলেন দারুণ সাবলীল। ৪৯তম ওভারে আউট হওয়ার আগে চারটি চার ও এক ছক্কায় ৮৭ বলে করেন ৮৩ রান। তামিমকে নিয়ে শুরুর ধাক্কা সামাল দেয়া সাকিব ৬৯ বলে করেন ৫১ রান।

লিটনের বিদায়ের পর সাকিব ও তামিমের জুটি বেশ জমে উঠেছিল। ৫৩ বলে ৩৬ রান করা তামিমকে বোল্ড করে ৫৯ রানের এই জুটি ভাঙেন নবী। এরপর মুশফিকের সঙ্গে ৬১ রানের আরেকটি ভালো জুটি গড়ে মুজিবের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হন সাকিব।

পাঁচে নামা সৌম্যকেও দ্রুত এলবিডব্লুর ফাঁদে ফেলেন মুজিব। এরপর মাহমুদউল্লাহ (২৭) ও চোট কাটিয়ে ফেরা মোসাদ্দেককে নিয়ে দলকে এগিয়ে নেন মুশফিক। ২৪ বলে ৩৫ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে একদম শেষ বলে আউট হন মোসাদ্দেক।

৩৯ রানে তিন উইকেট নিয়ে আফগানিস্তানের সফলতম বোলার মুজিব। এছাড়া গুলবাদিন নাইব দুটি এবং দৌলত জাদরান ও নবী নেন একটি করে উইকেট। ১০ ওভারে ৫২ রান দিয়ে উইকেটশূন্য ছিলেন রশিদ খান। বোলিংটা আফগানিস্তানের খারাপ না হলেও ব্যাটিং ব্যর্থতায় সাত ম্যাচ শেষেও তাদের পয়েন্টের খাতা শূন্য।

এরশাদের অভিনন্দন : বিশ্বকাপ ক্রিকেটে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রত্যাশিত জয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। এক অভিনন্দন বার্তায় সোমবার খেলোয়াড়দের পাশাপাশি ক্রিকেট কোচ, ক্রিকেট বোর্ড ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে তিনি অভিনন্দন জানান।

অভিনন্দন বার্তায় এরশাদ বলেন, আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই জয়ে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের শক্তি ও সামর্থ্য প্রমাণ হয়েছে। আগামী সব ম্যাচে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বিজয়ের ধারা অব্যাহত থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের, সিনিয়র কো- চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতা বেগম রওশন এরশাদ এবং পার্টির মহাসচিব ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা।