পাপীকে অবশ্যই পাপের শাস্তি ভোগ করতে হবে—এটা ন্যায়বিচারের দাবি। এ শাস্তি কারো ইহকালে, আবার কারো হবে পরকালে। পার্থিব জগতে কোন পাপের কী শাস্তি হয়, এ বিষয়ে নিম্নে আলোচনা করা হলো—
আত্মসাৎ করা : আত্মসাৎ করা মারাত্মক গুনাহ ও জঘন্য অপরাধ। মালিক ক্ষমা না করলে এ গুনাহ আদৌ ক্ষমা হবে না। তাকে অবশ্যই জাহান্নামের অনলে জ্বলতে হবে। জায়েদ ইবনে খালিদ জুহানি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খায়বার যুদ্ধে জনৈক ব্যক্তি কোনো দ্রব্য আত্মসাৎ করে। পরে সে মারা গেলে মহানবী (সা.) তার জানাজা পড়াননি। তিনি সাহাবিদের উদ্দেশে বলেন, তোমাদের এ সঙ্গী আল্লাহর পথের সম্পদ আত্মসাৎ করেছে। বর্ণনাকারী বলেন, আমরা তার জিনিসপত্র তল্লাশি করে তাতে একটি রেশমি বস্ত্র পেলাম, যার মূল্য হবে দুই দিরহাম। (তিরমিজি, মিশকাত, পৃ. ২৪২)
ব্যভিচার করা : ব্যভিচারের শাস্তি ভয়াবহ। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ব্যভিচারের মন্দ পরিণাম ছয়টি। তিনটি দুনিয়ায়, আর তিনটি আখিরাতে। দুনিয়ার তিনটি হলো ১. সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া, ২. দারিদ্র্য ও ৩. অকালমৃত্যু। আর আখিরাতের তিনটি হলো ১. আল্লাহর অসন্তুষ্টি, ২. হিসাব-নিকাশের কঠোরতা ও ৩. জাহান্নামের কঠিন শাস্তি (ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ, ই.ফা. পৃ. ১০৯)। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তীও হয়ো না। কারণ তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩২)
পরিমাণ ও ওজনে কম দেওয়া : পরিমাপে ও ওজনে কম দেওয়া নিষেধ। এটি জঘন্যতম খিয়ানত ও গুনাহে কবিরা। এর ফলে আল্লাহ তাআলা ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দেন ও দুর্ভিক্ষ দেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা মাপে কম দেয়, যারা মানুষের কাছ থেকে ওজন করে নেওয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে, আর যখন মানুষকে মেপে কিংবা ওজন করে দেয়, তখন কম দেয়।’ (সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১-৩)
প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা : প্রতিশ্রুতি করলে তা পূরণ করা আবশ্যক। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা নিষেধ ও গুনাহে কবিরা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা অঙ্গীকার পূরণ করো। কেননা প্রতিশ্রুতি পূরণের বিষয়ে তোমাদের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৪)
মহানবী (সা.) বলেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই, তার মধ্যে ঈমান নেই। অনুরূপ যে ব্যক্তি অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার মধ্যে দ্বিন নেই।’ (বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠা : ১৫)
তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘মুনাফিকের নিদর্শন তিনটি। কথা বললে মিথ্যা বলে, অঙ্গীকার করলে ভঙ্গ করে, আমানত রাখলে খিয়ানত করে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে চারটি। চতুর্থটি হলো যখন বিবাদ করে, গালাগালি করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হিংসা করা : হিংসা নেকগুলো ধ্বংস করে দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা হিংসা পুণ্যকে এমনভাবে বিনষ্ট করে দেয়, যেভাবে আগুন কাঠকে ভস্মীভূত করে দেয়।’ (আবু দাউদ)
হিংসা থেকে বেঁচে থাকা ফরজ। কারণ তা এমন নীরব অনল, যা ক্রমে ক্রমে জ্বলে ওঠে এবং মানুষের নেকগুলো ধ্বংস করে দেয়। অথচ মানুষের কোনো খবরই থাকে না যে তার নেকগুলো নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
সুদ খাওয়া : সুদের ৭০ প্রকার গুনাহ রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নতম গুনাহ হলো স্বীয় মাকে বিবাহ করা। (মিশকাত, পৃষ্ঠা : ২৪৬)
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যারা সুদ খায় (বিচার দিবসে) তারা সে ব্যক্তির মতো দাঁড়াবে, যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দিয়েছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)
ঘুষ খাওয়া : ঘুষ আদান-প্রদান করা লানতযোগ্য কাজ। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের প্রতি আল্লাহ তাআলার লানত।’ (আন-নিহায়া ফি গারিবিল হাদিস, ইবনুল আসির, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা : ২২৬)
মদ পান ও জুয়া খেলা : মদ পান ও জুয়া খেলা উভয় শয়তানের কাজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদি ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন করো, তাহলেই তোমরা সফলকাম হতে পারবে’ (সুরা আল মায়িদা, আয়াত : ৯০)
মজুদদারি ও কালোবাজারি : মূল্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে খাদ্যদ্রব্য মজুদ রাখা এবং কালোবাজারি সম্পূর্ণরূপে হারাম। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (মুসলমান) খাদ্যশস্য আটকে রাখে (মজুদদারি করে) আল্লাহ তাআলা তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজাহ ও বায়হাকি, মিশকাত, পৃষ্ঠা : ২৫১)
চুরি করা : চুরি করা জঘন্য অপরাধ। চুরি সমাজকে শান্তি থেকে বিদূরিত করে দেয়। এর শাস্তি হলো, কবজি পর্যন্ত হাত কেটে দেওয়া। যেমন আল্লাহর বাণী—পুরুষ চোর ও নারী চোর অপরাধের শাস্তিস্বরূপ উভয়ের হাত কবজি পর্যন্ত কেটে দাও।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩৮)
ডাকাতি ও ছিনতাই : ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট ইত্যাদি চুরি অপেক্ষা গুরুতর অপরাধ। কারণ চুরি হয় গোপনে। আর ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাট হয় প্রকাশ্যে। এদের শাস্তি হলো হত্যা, শূলে চড়ানো, হাত-পা কেটে ফেলা ও দেশ থেকে বহিষ্কার করা। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে লুটপাট করে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (আবু দাউদ, মিশকাত, পৃষ্ঠা : ৩১৩)
বর্তমানে পৃথিবীতে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে নিষিদ্ধ সব কার্যকলাপ অহরহ হচ্ছে। মুসলিম-অমুসলিম কেউই পাপ করতে দ্বিধাবোধ করছে না। এর পরও আগের বিভিন্ন জাতির মতো কেন প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগ আসছে না, এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা সুরা আনফালের ৩৩ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন। সেখানে দুটি কারণে প্রাকৃতিক মহাদুর্যোগ আসছে না—এক. মহানবী (সা.) মানুষের মাঝে বিদ্যমান আছেন, তথা তাঁর নবুয়ত চলছে, আর দ্বিতীয় কারণ হলো এমন কিছু খাঁটি বান্দা রয়েছে, যারা সদা ইস্তিগফার করেন। এ দুটি কারণে আগের মতো আজাব প্রেরিত হয় না। তা ছাড়া হাদিস শরিফে আরো একটি কারণ পাওয়া যায়। সেটি হলো, মহানবী (সা.)-এর আগমনের পর মহান আল্লাহ এ জাতিকে সমূলে ধ্বংস না করার ওয়াদা করেছেন। তাই হাজারও পাপ সত্ত্বেও বর্তমানে আগের মতো আজাব নাজিল করা হয় না।
লেখক : প্রধান ফকিহ
আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।