সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি কখনো বাড়ছে কখনো কমছে। আর এ অবস্থায় সিরাজগঞ্জ সদর, শাহজাদপুর আর চৌহালী উপজেলার যমুনা তীরবর্তী অঞ্চল জুড়ে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের ঘাটাবাড়ি, পাকুড়তলাসহ পাশের গ্রামগুলোর প্রায় ২ শতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। পানির প্রবল তোড়ে ভাঙনের তীব্রতা ক্রমশ বাড়ছে। ভাঙছে সদর উপজেলার ছোনগাছা ইউনিয়নের পাঁচঠাকুরী এলাকাসহ চৌহালী উপজেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

যমুনার ভাঙনের কবলে পড়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছে যমুনা তীরবর্তী অসংখ্য মানুষ। চোখের সামনে একের পর এক ঘরবাড়ি, জমিজমাসহ বিভিন্ন স্থাপনা যমুনাগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার পরেও ভাঙন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ার যমুনা তীরবর্তী এলাকাবাসী মানববন্ধন ও অনশন পর্যন্ত করেছেন। 

শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুর ইউনিয়নের ঘাটাবাড়ি এলাকার বৃদ্ধ ইয়াছিন প্রামাণিক (৮০) ও রহম আলী মোল্লা (৭২) গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে বাঁধ নির্মাণের দাবিতে যমুনার তীরে অনশন করেন। পরে ২২ সেপ্টেম্বর পাউবোর কর্মকর্তারা গিয়ে বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দিলে অনশন ভাঙেন তারা। এখন তাদের একটাই দাবি- ‘ত্রাণ চাই না, যমুনা তীর সংরক্ষণ বাঁধ চাই’।

চৌহালী উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলকে যমুনা ভাঙনের কবল থেকে রক্ষায় এলাকাবাসীর উদ্যোগে ২১ সেপ্টেম্বর  মানববন্ধন কর্মসূচি পালিত হয়েছে। চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়নের বিনুনইন বাজারের পশ্চিম, মিটুয়ানী, চরসলিমাবাদ ও ভূতের মোড়সহ প্রায় ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ছাত্র-শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। তাদেরও দাবি ছিল- ত্রাণ চাই না, যমুনা তীর সংরক্ষণ বাঁধ চাই। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ দ্রুত স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এলাকার প্রবীণ ইয়াসিন প্রামাণিক (৮০) ও রহম আলী মোল্লা আবেগজড়িত কণ্ঠে  বলেন, ৭ থেকে ৮ বার বাড়ি ভাঙনের কবলে পড়েছেন তারা। জমিজমা সব ভাঙনে গেছে। এখন সামান্য বাড়ির ভিটা আছে। আবারো শুরু হয়েছে তীব্র ভাঙন। ভিটেটুকু গেলে আর যাব কোথায়? কিন্ত ৩-৪ বছর ধরে শুনছি বাঁধ নির্মাণ হবে। কিন্ত আজও তা হলো না। সরকার এই জায়গায় বাঁধ  নির্মাণ করে দিলে ভাঙন রোধ হতো। আমাদের মতো  শত শত গরীব মানুষের বাড়ি-জমি রক্ষা পেত। 

জালালপুর ইউনিয়নের ঘাটাবাড়ি এলাকার নুরু ফকির (৭২),  শফিউল্লাহ মুন্সী (৮০), তয়জাল ফকির (৬৫) ও রহম আলী মোল্লাসহ (৭২)  এলাকাবাসী জানান, এনায়েতপুরের ব্রাক্ষণগ্রাম থেকে হাট প্রাচীল পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকা যমুনার ভাঙনমুক্ত না করায় চোখের সামনে একের পর এক তাদের জমিজমা ঘরবাড়ি সব যমুনার পেটে যাচ্ছে। দশবার যমুনার ভাঙনের শিকার হয়ে তারা ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন। শেষ সম্বল তাদের ভিটাটুকু আর যমুনাকে দিতে চান না। 

জালালপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান  সুলতান মাহমুদ জানান, চলতি (সেপ্টেম্বর) মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ব্রাক্ষ্মণগ্রাম, আড়কান্দি, ঘাটাবাড়ি, পাকুরতলা, কুঠিপাড়া, ভেকা ও পাচিল গ্রামের ২ শতাধিক ঘরবাড়ি ও বিস্তীর্ণ ফসলি জমি যমুনাগর্ভে বিলীন হয়েছে। ভয়াবহ ভাঙনের কারণে নদীর অদূরে রয়েছে এনায়েতপুর-সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক ও দেশের সর্ববৃহৎ এনায়েতপুর কাপড়ের হাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ক্রমাগত ভাঙনের হুমকির সন্মুখীন হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের প্রতি ভাঙন রোধে দ্রুত উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন তিনি।

এদিকে,  ভাঙনের কবলে পড়েছে সিরাজগঞ্জের চৌহালি উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকা। তীব্র ভাঙনে ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে দক্ষিণ চৌহালির বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

স্থানীয়রা জানান, আগস্ট মাসের শেষ দিক থেকেই দক্ষিণ চৌহালির বাঘুটিয়া ও খাসপুখুরিয়া ইউনিয়নে ভাঙন শুরু হয়। এরই মধ্যে ওই দুটি ইউনিয়নের পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর, শত শত বিঘা ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙন আতঙ্কে মানুষ বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। গত কয়েক সপ্তাহ আগেই এসব অঞ্চলের মানুষ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছিলেন। এ অবস্থায় ভাঙন আতঙ্কে যমুনা পাড়ের জনগণ চরম বিপাকে পড়েছেন। বর্ষা মৌসুমের শুরুতে যমুনায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাসপুখুরিয়া থেকে বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চর বিনানুই পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাঙন শুরু হয়। যমুনার পানি দফায় দফায় হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে ভাঙনের তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে খাসপুখুরিয়া ও বাঘুটিয়া ইউনিয়নের চর বিনানুই হাটাইল, চর নাকালিয়া, ভুতেরমোড়, খাসপুখুরিয়া, মেটুয়ানী এলাকার পাঁচ শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। একই সঙ্গে কয়েক শত বিঘার ফসলি জমিও বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে বহু ঘরবাড়ি ও স্থাপনা।

চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল কাহার সিদ্দীকি, স্থানীয় মোল্লা মুকুট ও কালাম মোল্লা বলেন, প্রায় এক যুগ ধরে চৌহালী উপজেলায় নদী ভাঙন চলছে। এতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা নদীগর্ভে চলে গেছে। চলতি মাসে আবারো শুরু হয়েছে ভয়াবহ ভাঙন। এতে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি বিলীন হয়েছে।

পাউবোসহ বিভিন্ন দপ্তরে জানিয়েও কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় বাধ্য হয়ে মানববন্ধন  করতে বাধ্য হয়েছেন এলাকাবাসী। তারাও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীতা কামানা করেন।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, অনশনকারীদের সঙ্গে আমরা সমব্যথী। তিনি আরো জানান, কাজীপুরের পাটাগ্রাম এবং এনায়েতপুরের ব্রাক্ষণগ্রাম থেকে শাহজাদপুরের কৈজুড়ী পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার এলাকা অনেকটা অরক্ষিত রয়েছে। এই দুটি স্থানে ভাঙন রয়েছে। ভাঙন রোধে সাড়ে ১১ শ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।

চৌহালী উপজেলার দায়িত্বে থাকা টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, ভাঙনরোধে এখন ওই এলাকায় জিওটেক্স বালুর বস্তা ফেলার কাজ চলছে। এছাড়া ওই এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য সাড়ে ৬ শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প জমা দেওয়া আছে। প্রকল্পটি অনুমোদন হলেই এই এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হবে।