বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী থেকে ফাঁসির আসামি হয়েছেন নিহত রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। এ মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির মধ্যে রাকিবুল হাসান রিফাত ওরফে রিফাত ফরাজী এবং আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয় জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলার প্রাপ্তবয়স্ক অপর চার আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে। বুধবার দুপুরে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান এ রায় ঘোষণা করেন।

রায় ঘোষণার সময় বিচারক মো. আছাদুজ্জামান উল্লেখ করেন, এ মামলার প্রধান সাক্ষী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি ঘটনার শিকার রিফাত শরীফকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনায় তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের সময় রিফাত শরীফকে যখন অন্যান্য আসামিরা কলার ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি তাদের পেছনে পেছনে ধীর পায়ে হেঁটে আসছিলেন।

এ বিষয়ে রাষ্ট্র পক্ষের আইনজীবী অ্যাড. মুজিবুল হক কিসলু জানান, মিন্নি প্রথমে এ মামলার সাক্ষী ছিল এটা সত্য। কারণ যখন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সেখানে নিহত রিফাতের বাবা উপস্থিত ছিলেন না। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পুত্রবধূ আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। তখন সরল মনে রিফাত শরীফের বাবা আ. হালিম দুলাল শরীফ পুত্রবধূ মিন্নিকে এ মামলার এক নম্বর সাক্ষী রাখেন। পরে যখন তিনি বুঝতে পারেন যে, মিন্নির সাথে হত্যাকারী নয়নবন্ডের বিয়ে এবং সখ্যতা ছিলো। যখন তিনি এ হত্যাকান্ডের পেছনে মিন্নির পূর্বপরিকল্পনার বিষয়টি বুঝতে পারেন তখনই তিনি সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।

অ্যাড. মুজিবুল হক কিসলু আরো বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের আগে এবং পরে নয়ন বন্ডসহ হত্যাকারীদের সঙ্গে মিন্নির একাধিকবার যোগাযোগের বিষয়টি আদালতের কাছে প্রমাণিত হযেছে। রিফাত শরীফের আগে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের কাবিন দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কাজীও আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। হত্যাকান্ডের আগে নয়ন বন্ডের বাসায় মিন্নি নয়নবন্ডের সঙ্গে একান্তে সময়ও কাটিয়েছেন। নয়নবন্ডের বাসা থেকে পুলিশ মিন্নির সেসব আলামতও জব্দ করেছেন। 

রাষ্ট্রপক্ষ এবং আসামিপক্ষের সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, বেলা সোয়া ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ৯ জন আসামির উপস্থিতিতে এ রায়ের বিশেষ বিশেষ অংশ পড়ে শোনান বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান। এ সময় মামলার মূল পর্যবেক্ষণে তিনি উল্লেখ করেন, প্রকাশ্যে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে সংঘটিত এ নির্মম হত্যাকাণ্ড মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত সকল অপরাধীর প্রত্যেকের বয়স ২৩ বছরের নীচে। তথ্য প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাদ্যমের বদৌলতে যুবসমাজসহ দেশ-বিদেশের সব বয়সের মানুষ এ নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছে। এ অবস্থায় এসব অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তাদের অনুসরণ করে দেশের তরুণ সমাজ ভুল পথে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

গত বছরের ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত শরীফকে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর যখম করে বরগুনার কিশোর গ্যাং বন্ড বাহিনী। পরে ওইদিন বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন রিফাত। এ ঘটনার পরের দিন বরগুনা সদর থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৫-৬ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। এতে মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করা হয়।

পরে এ হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতা নয়ন বন্ডের সাথে মিন্নির বিয়ের কাবিনের বিষয়টি ফাঁস হয়। একই সাথে বের হয়ে আসে হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও নয়নবন্ডের বাসায় মিন্নির যাওয়া আসার খবর। রিফাত হত্যাকাণ্ডের ১৭ দিন পর বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মিন্নিকে এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইড উল্লেখ করে তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ।

রিফাতের মৃত্যুর ১৯ দিন পর গত বছরের ১৬ জুলাই সকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ লাইনে নিয়ে আসে পুলিশ। এরপর ওইদিন রাতেই এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মিন্নিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরের দিন ১৭ জুলাই বরগুনার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে মিন্নির সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। আদালত মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনেই বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বামী হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা শিকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন মিন্নি। এরপর থেকে টানা ৪৯ দিন কারাভোগের পর গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হন তিনি। আর মিন্নির কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার দুদিন আগে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিকালে মিন্নিকে প্রাপ্তবয়স্ক আসামরিদের মধ্যে সাত নম্বর অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। চার্জশিটে মিন্নিকে এ হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়।