ইসলামপন্থী সংগঠন হেফাজতের বিষয়ে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করলেও ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধী নয় বিএনপি। মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাস্কর্য থাকায় দলটি এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া যৌক্তিক মনে করে না। তা ছাড়া নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এবং চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য রয়েছে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য দিলেও বিএনপি হেফাজতের পাশে থাকতে রাজি নয়।

একই সঙ্গে আবার হেফাজত ও আলেমসমাজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সরকারকে সুবিধা পাইয়ে দিতেও চায় না দলটি। কারণ বিএনপি এখন ‘যেকোনো মূল্যে’ সরকারের বিদায় চায়। ফলে সরকারকে চাপে ফেলতে পারে, এমন যেকোনো শক্তির পক্ষে বিএনপির নীরব সমর্থন রয়েছে। হেফাজতের সঙ্গে দলটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে বলে জানা যায়।

জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভাস্কর্য ইস্যুতে আমরা কথা বলতে চাই না। তবে বিএনপি মৌলবাদী দল নয় এবং মৌলবাদের সঙ্গে বিএনপির কোনো সম্পর্কও নেই।’

মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এবং বাংলাদেশে জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। তবে সমস্যা হলো—আওয়ামী লীগের মতলব নিয়ে। তারা বিএনপিকে বিপাকে ফেলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায়। সে কারণেই এ প্রশ্নে আমরা কথা বলতে রাজি নই।’

লন্ডনে বসে হেফাজত নেতাদের তারেক রহমান মদদ দিচ্ছেন বলে গত সোমবার অভিযোগ করেছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ঠাকুরগাঁও থেকে টেলিফোনে ফখরুল বলেন, ‘এটাই তো আওয়ামী লীগের সমস্যা। তারা সব কিছুর মধ্যে বিএনপির ভূত দেখে। কথায় কথায় এ জন্যই তারেক রহমানের নাম নিয়ে বিষোদগার করে। কিন্তু এতে কোনো লাভ হবে না।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় উচ্চকণ্ঠ কে বলেন, ‘ভাস্কর্য ইস্যুতে আমরা কোনো কথা বলছি না। কারণ বিএনপির প্রধান ইস্যু গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। তা ছাড়া ওই ভাস্কর্য ইস্যু সরকারের কোনো পাতানো খেলা কি না, সেটাও ভেবে দেখতে হবে।’

প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের লোক বসবাস করে। তাদের কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কাজ রাষ্ট্রের করা উচিত নয়।’

বিএনপির নীতিনির্ধারক বলে পরিচিত একাধিক নেতার সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, দুটি বিষয় বিবেচনা করে ভাস্কর্য ইস্যুতে দলটি নীরব থাকার পক্ষে। প্রথমত, ইসলামী শক্তি বলে পরিচিত হেফাজতকে তারা চটাতে চাইছে না। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে ‘মৌলবাদী’ হিসেবে পরিচিত হতেও রাজি নয় দলটি। ধর্মীয় ইস্যু তৈরি করে সরকার বিএনপিকে মাঠে নামাতে চাইছে বলে বর্তমান সময়েও বিএনপির মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর বিএনপি এ ক্ষেত্রে বেশ সতর্ক। কারণ দলটির নেতাদের অনেকে মনে করেন, ধর্মীয় মৌলবাদের কোনো ইস্যুর সঙ্গে এখন বিএনপিকে জড়াতে পারলে সরকার লাভবান হবে। কারণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তখন স্পষ্ট হবে যে বিএনপি একটি মৌলবাদী দল।

জামায়াতের সঙ্গে জোট এবং ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের ঘটনায় বিএনপির কিছুটা রাজনৈতিক ক্ষতি হয়েছে বলেও মনে করা হয়। সূত্র মতে, এ কারণেই হেফাজতের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেবে না বিএনপি। তবে আগামী সরকারবিরোধী আন্দোলন তথা নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা আবার হেফাজতের প্রভাবকে কাজে লাগাতেও চায়।

আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর হেফাজতের নতুন কমিটিতে সরকারপন্থীদের তুলনায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সমর্থকদের প্রাধান্য বেশি বলে মনে করা হয়। গত ১৫ নভেম্বর ঘোষিত নতুন কমিটির ১৬৭ জনের মধ্যে বেশির ভাগ নেতাই বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সমর্থক বলে আলোচনা আছে। তা ছাড়া নতুন আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবু নগরী ও মহাসচিব নূর হোসাইন কাসেমীও সরকারপন্থী বলে পরিচিত নয়। বরং বিএনপির সঙ্গে তাঁদর সুসম্পর্ক রয়েছে বলে মনে করা হয়। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, ইরাক, ইরানসহ বিভিন্ন দেশের সড়ক পথগুলোতে ভাস্কর্য থাকার বিষয়টিও বিএনপির মধ্যে আলোচনায় আছে।