লেখক ও অধিকারকর্মী মায়া অ্যাঞ্জেলো বলেছিলেন, ‘যখন কেউ নিজেকে প্রকাশ করতে চায় যে সে কে, তখন এ ধরনের লোকদের প্রথমবার বিশ্বাস করো।’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের উৎসাহী সমর্থকরা তাঁকে বিশ্বাস করেছিলেন। এর বাইরে আরো অনেকে, এমনকি যাঁরা তাঁর সমালোচক, তাঁদের মধ্যেও অনেকেই ভাবতেন, যা-ই ঘটুকু অন্তত তার একটা সীমা থাকবে। কিন্তু তাঁরা আর সন্তুষ্ট থাকতে পারছেন না। বুধবার রাতে আমেরিকার হত্যাযজ্ঞ—তথা মার্কিন রাজধানীতে প্রেসিডেন্টের দ্বারা প্ররোচিত একদল সশস্ত্র ও সহিংস জনতার তাণ্ডব, কংগ্রেসকে ভীতসন্ত্রস্ত করার চেষ্টা এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা দেওয়া—এসব ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এক অস্বাভাবিক মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। যেমন—গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ‘কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন’-এর প্রেসিডেন্ট রিচার্ড হাস লিখেছেন, যদি আমেরিকা-উত্তর যুগের কোনো শুরুর তারিখ লেখা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেই তারিখটা হবে ৭ জানুয়ারির দিনটা।
তা সত্ত্বেও এ ঘটনা চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে লোকটি শুধু তাঁর দপ্তরের জন্যই অযোগ্য নন, তিনি গণতন্ত্রের জন্যও বিপজ্জনক। তিনি মিথ্যাচার, গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের প্রতি অবজ্ঞা, বিভাজনের জ্বালানি, বর্ণবাদ ও সর্বোপরি বলপ্রয়োগকে মহিমান্বিত করার ওপর নির্ভর নিজের রাজনৈতিক সাফল্য নির্মাণ করেছেন।
প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার চলাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীকালে ধাপে ধাপে এর প্রমাণ মিলে, যখন ভোটে জয়লাভের উদ্দেশ্যে তিনি ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে হাউসে অভিশংসিত হন, যখন তিনি নির্বাচনে চুরি হয়ে যাবে বলে মিথ্যা বলেন এবং নির্বাচনের পরও চুরি হয়েছে বলে মিথ্যা বলে আসছেন, যখন তিনি সমর্থকদের ওয়াশিংটনে ডেকেছিলেন, যখন তিনি তাঁদের বলেছিলেন যে তাঁরা আর দেশটিকে কখনোই ‘দুর্বল’ দেশ হিসেবে ফিরে পেতে চান না।
সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা মিচ ম্যাককনেল ও অন্যরা প্রজাতন্ত্রের দুরবস্থা নিয়ে যে বিলম্বিত অনুরাগ দেখিয়েছেন, এ জন্য তাঁরা কোনো কৃতিত্ব পেতে পারেন না। যাঁরা ট্রাম্পের নির্বাচনে চুরির প্রচেষ্টাকে সাহায্য করেছেন কিংবা রসিকতা করেছেন, তাঁরা সবাই অপরাধী। এরই মধ্যে আরো ভদ্র উপায়ে ভোটার দমন ও জালিয়াতিতে বিশেষজ্ঞ রিপাবলিকান অভিজাতরা ট্রাম্পিজমকে সহায়তা ও উৎসাহিত করেছেন। ট্রাম্পের পাশে থেকে, তাঁকে অভিশংসন থেকে রেহাই দিয়ে, নীরব থেকে কিংবা মিথ্যাচারকে বাড়তে দিয়ে এই সহযোগিতা করা হয়েছে। তাঁরা একজন অগ্নিসংযোগকারীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এখন তাঁরা অগ্নিকুণ্ডের আগুন নেভাতে এক কাপ পানি ছিটানোর প্রস্তাব দিচ্ছেন।
এই মুহূর্তে জরুরি বিষয় হচ্ছে, কিভাবে ট্রাম্পকে সামলানো যায়। তিনি যখন ক্ষোভ উগরে দেওয়া অব্যাহত রেখেছেন, তখন তাঁর নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি নিয়ে শেষ মিনিট পর্যন্ত কোনো ভরসা রাখা যায় না। সিনেটের ডেমোক্রেটিক নেতা চাক শুমার অবিলম্বে তাঁকে অপসারণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। মন্ত্রিসভার সদস্যরা এখন ২৫তম সংশোধনীর ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করছেন, যাতে একজন ‘অযোগ্য‘ প্রেসিডেন্টকে বদল করা যায়। তবে এটা শুধুই ব্যর্থতা বা অক্ষমতার বিষয় নয়, এর চেয়ে ভালো উপায় হবে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া শুরু করা। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে তিনি আর দৌড়াতে না পারেন।
কিভাবে আমেরিকার গণতন্ত্র রক্ষা করা যায়, সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বুধবারের ঘটনা কিছুসংখ্যক ট্রাম্প ভোটারের জেগে ওঠার প্রমাণ হলেও এরই মধ্যে অনেক লোকজন ঘটনাটির ভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করছেন, এমনকি এটাকে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার (বিএলএম) আন্দোলনের সঙ্গেও কাল্পনিক তুলনা টেনে একটি অজুহাত দাঁড় করাচ্ছেন। বিএলএম আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ ও আগ্রাসী ভূমিকা নিতে দেখা গেল। অথচ বুধবারের ঘটনা নিয়ে চরমপন্থীরা প্রকাশ্যে তাদের পরিকল্পনার কথা বললেও ক্যাপিটল ভবন রক্ষায় কোনো ব্যবস্থা দেখা গেল না। তাই ব্যর্থতার একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কোটি কোটি আমেরিকান এখন বিশ্বাস করে যে নির্বাচনে চুরি হয়ে গেছে। একটি রিপোর্ট বলছে, রিপাবলিকানদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ নির্বাচনের এই ফলাফলের ওপর আস্থা রাখে। ডানপন্থী গণমাধ্যমগুলো তো মিথ্যাচারকে আরো হূষ্টপুষ্ট করছে এবং সোশ্যাল মিডিয়া লোকজনকে একটি বিকল্প রাজনৈতিক জগতে বসবাসের সুযোগ করে দিচ্ছে। যদিও ফেসবুক অবশেষে প্রেসিডেন্টের অ্যাকাউন্ট স্থগিত করেছে; কিন্তু ভুল তথ্য এত দ্রুত ও দূরে ছড়িয়েছে যে একটি স্থিতিশীল দরজা দীর্ঘদিনের জন্যই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
কাগজপত্রে লেখা বিধি-বিধানে গণতন্ত্র বেঁচে থাকে না, বেঁচে থাকে যত দিন এর চর্চা করা হয় কিংবা বলা যায়, রক্ষা করা হয়। এরই মধ্যে গত বুধবার জর্জিয়ার নির্বাচনে তাৎপর্যপূর্ণ ‘জোড়া’ বিজয় সিনেটে ডেমোক্র্যাটদের নিয়ন্ত্রণ এনে দিয়েছে। এই বিজয় সম্ভাব্য কর্তব্যকে স্বাগত জানাচ্ছে। কিন্তু স্বয়ং প্রক্রিয়ার মধ্যেই হুমকি থাকার কারণে তার গুরুত্ব খর্ব হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং লড়াই কেবলই শুরু হচ্ছে। এই যুদ্ধ কেমন হতে পারে সেটা আমেরিকা তার জনগণকে দেখিয়েছে। এখন তাদের এটা বিশ্বাস করা উচিত এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা উচিত।
সূত্র : সম্পাদকীয়, দ্য গার্ডিয়ান
ভাষান্তর : আফছার আহমেদ