মাহফুজ বাবু
কুমিল্লায় এবছর বোরো’র বাম্পার ফলন হয়েছে। বরোর উৎপাদন নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে ধরনা করা হচ্ছে। সোনালী পাকা ধান ক্ষেত জুড়ে, একযোগে শুরু হয়েছে ধান কাটার আয়োজন। যার ফলে কৃষি শ্রমিকের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। মৌসুমের শুরুতেই মহামারি করোনা প্রাদুর্ভাবে সরকার ঘোষিত লকডাউন থাকায় দেশের অন্যান্য জেলা থেকে কুমিল্লায় আসতে পারছেন না শ্রমিকরা। এতে করে শ্রমিক সংকটে কৃষকরা চড়া মজুরি দিয়েও মিলছে না কৃষি শ্রমিক। যথা সময়ে শ্রমিক না পাওয়া গেলে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এদিকে জেলা কৃষি অফিস বলছে, শ্রমিক সংকটে যাতে না পড়তে হয় সেজন্য জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের বিশেষ অনুমতিতে উত্তরবঙ্গ সহ অন্যান্য জেলায় বাস পাঠিয়ে আনা হচ্ছে ধানকাটা শ্রমিক।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, এবছর জেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। কুমিল্লা জেলায় এক লাখ ৫৮ হাজার ৮৮০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৫০ হেক্টর বেশি। জেলায় এখন পযর্ন্ত ১০ শতাংশেরও কম জমির ধান কাটা হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে পুরোপুরি ধান কাটা শুরু হবে। কৃষকদের ধান কাটার সহযোগিতায় ৮৫টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন ও ৭৯ টি রিপার রয়েছে।
তাছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে কৃষি শ্রমিক আনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। দেখা যায়, বছরের এই সময়ে চারদিকে ধান কাটার উৎসব শুরু হয়। উত্তরবঙ্গের রংপুর দিনাজপুর গাইবান্ধা কুড়িগ্রাম সহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মৌসুমি শ্রমিকরা দৈনিক মজুরি কিংবা চুক্তিতে ধান কেটে কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকের ঘরে ফসল তুলে দেন। এসময় কুমিল্লায় শ্রম বেচাকেনার হাটগুলোও বেশ জমে উঠে। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শ্রমিকদের শ্রম বিক্রয় হয় দিন, সপ্তাহ কিংবা মাস চুক্তিতে। তবে শ্রমিক সংকট থাকলে মজুরি বেড়ে যায় দুই-তিন গুণ। এবছর লকডাউন থাকায় মৌসুম শুরুতেই শ্রমিক আসতে পারেনি কুমিল্লায়। যাদের ধান আগে পেকে গেছে তারা অনেকেই দ্বিগুণ দামে শ্রমিক রেখে ধান তুলেছেন। কেউ কেউ আবার পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে নিয়েও বাধ্য হয়েই ধান কাটা ও তোলার কাজ করেছেন।
কুমিল্লা বুড়িচং উপজেলার কোষাইআম এলাকার কৃষক জসিম নিজেই নিজের জমি থেকে পরিবারের কয়েক জনকে নিয়ে ধান কাটছেন। তিনি বলেন একদিনের জন্য ১হাজার টাকা করে দৈনিক মজুরিতে দুই জনকে দিয়ে ধানগুলো কাটিয়েছেন। এখন শ্রমিক পাচ্ছেন না তাই নিজে নিজে যতটুকু পারা যায় ঘরে তুলে নিচ্ছেন। নয়তো বৃষ্টির কবলে পরলে ধান মাঠেই নষ্ট হয়ে যাবে। আরো কয়েকজন জানান ক্যান্টনমেন্ট বাজারে গিয়ে দুই দিন ঘুরে এসেছি এত চড়া দাম দিয়ে শ্রমিক আনলে পোষাবে না। কৃষকরা জানায় দৈনিক মজুরিতে ৮০০ টাকায় শ্রমিক এনে এই ধানের দাম পাওয়া যাবে সর্বোচ্চ ১২শ’ টাকা। তাহলে কৃষকের লাভ কি, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
নগরীর কান্দিরপাড়, পদুয়ার বাজার, শুয়াগাজী বাজার, চৌয়ারা বাজার, নিমসার বাজার, লালমাই বাজার, ক্যান্টনমেন্ট বাজার, ইলিয়টগঞ্জ বাজার, দেবিদ্বার বাজার, মুরাদনগর বাজার, বাঘমারা, বিজরা বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে দৈনিক বা চুক্তিভিত্তিক মজুরিতে শ্রমিক পাওয়া যায়। ধানকাটা মৌসুমে প্রতিদিনই এ সব বাজারে শ্রম বিক্রির জন্য একটু বেশি ভিড় করে শ্রমজীবী মানুষরা। পণ্যের মতো বিক্রি হয় তাদের শ্রম। শ্রমিক সংকট থাকলে মজুরি বাড়ে দিনের পর দিন। সংকটকালে প্রতিজন কৃষি শ্রমিকের দৈনিক মজুরি নির্ধারণ হয় ৮০০ থেকে হাজার টাকা টাকা। সাথে খাবার সহ অন্যান্য সুবিধা। শ্রমিকের সহজলভ্যতা বাড়লে কমে আসে মজুরিও, সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায় দৈনিক মজুরিতে শ্রমিক মিলে। কুমিল্লার হাট-বাজারে শ্রম বিক্রি করতে আসা মানুষরা বেশিরভাগই রংপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, নেত্রকোনা ও ঠাকুরগাঁওসহ দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর বাসিন্দা। পাঁচথুবী এলাকায় ধান কাটতে আসা নীলফামারীর শ্রমিক নিলফামারী সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আবুল কালাম বলেন, কলেজ বন্ধ তাই এলাকার বড়ভাইদের সাথে কাজ করতে এসেছেন এখানে। ৯দিন হলো এসেছেন বাড়ি থেকে, বিষ্ণুপুর এলাকায় কাজ করছেন প্রতিদিন সারে ৭শত টাকা রোজে। ঈদের আগে বাড়ি ফিরবেন আবার।
এখানে শ্রমের ভালো মজুরি পাওয়া যায়। রোজ এবং চুক্তি দুভাবেই দিনে ও রাতে কাজ করেন তারা। জানা যায়, কুমিল্লার স্থানীয় ধানকাটা শ্রমিক ছাড়াও উত্তরবঙ্গসহ অন্যান্য জেলা থেকে শ্রমিক আনতে বিশেষ ব্যবস্থা করছে কৃষি বিভাগ। যেসব শ্রমিকরা কুমিল্লায় আছেন তারা এবং কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অন্য শ্রমিকদের আনতে বাস পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া কেউ যদি লকডাউনে ধানকাটার জন্য শ্রমিক আনাতে চায় তাহলে উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থায় শ্রমিক আনাতে পারবে । কুমিল্লা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বোরো ধান বেশি উৎপাদন হয়েছে। এবার করোনা ও লকডাউনের কারণে যাতে শ্রমিক সংকটে না পড়ে সে জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
ধান কাটার অনেক যন্ত্রপাতি রয়েছে আমাদের। তাছাড়া জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা ইতোমধ্যে ১০টি বাস দেশের উত্তরাঞ্চলে পাঠিয়েছি শ্রমিক আনতে, পর্যায়ক্রমে আরও পাঠাবো। অন্য জেলা থেকে শ্রমিকদের বহনকৃত বাস আসতে আমরা বাঁধা দিচ্ছি না। এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার শ্রমিক আনা হয়েছে। আশা করি বাকি সময়ের মধ্যে কুমিল্লায় আর শ্রমিক সংকট থাকবে না। খবর নিয়ে জেনেছি- শ্রমিকদের মজুরিও কমে এসেছে। এখন আর কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না বলেই আশাকরি । আগামী দিনগুলোতে ভালো আবহাওয়া থাকলেই হয়।