ছাত্রলীগ। সংগঠনটির ছায়াতলে থাকার কথা শুধু ছাত্রদের। কিন্তু বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের কমিটি গেল ছয় বছরে এমনই ঝুনো হয়েছে, এখন ওই কমিটিতে ছাত্র খুঁজতেই চালাতে হয়েছে ‘চিরুনি অনুসন্ধান’! সেই অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ১৫৭ সদস্যের বিশাল ওই কমিটির নেতাদের নানা কীর্তি। সভাপতিসহ ৩৮ নেতা এরই মধ্যে বেঁধেছেন গাঁটছড়া। রকমারি ব্যবসায় যুক্ত ৪৮ জন, সরকারি-বেসরকারি চাকুরে ১৭ ছাত্রনেতা। ১৫ নেতার নামে ঝুলছে হত্যাসহ হরেক মামলা। জনপ্রতিনিধিও আছেন দুজন। চাঁদাবাজি, মাস্তানি, মাদক কারবারের বিস্তর অভিযোগও রয়েছে অনেক নেতার বিরুদ্ধে।

kalerkantho

সামনেই হতে পারে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের নয়া কমিটি। নেতৃত্বে নিজের নাম দেখতে ঝুনো কমিটিরই কয়েক নেতা ইনিয়ে-বিনিয়ে এখনো ছাত্রত্বের পিদিম জ্বালিয়ে রাখার চেষ্টারত। তাঁদের অনেকেই এখনো ‘অকারণে’ স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের ছাত্র! ফলে নতুন কমিটি গঠনে প্রকৃত ছাত্রনেতা বাছাইয়ে বেকায়দায় পড়তে পারেন কেন্দ্রীয় নেতারা। মজার ব্যাপার হলো, ছাত্রলীগের জেলা কমিটির নেতারা নিজেদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করলেও কেউই সংগঠনকে বিদায় জানাননি। করেননি পদত্যাগ, দেননি ইস্তফা।

এদিকে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০১৫ সালের ৭ মে। পরে ১১ মে ঘোষণা করা হয় কমিটি। পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা আসতে আসতে লেগে যায় ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের জেলা-উপজেলা ও কলেজ কমিটির মেয়াদকাল হওয়ার কথা এক বছর। তবে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের কমিটির মেয়াদ ছয় বছর পেরিয়ে দিয়েছে সাতে পা। তাই ওই কমিটিতে এখন আর ছাত্রের দেখা নেই। এখন চলে লোক-দেখানো দলীয় কর্মকাণ্ড, নেই সাংগঠনিক কোনো গতি। দীর্ঘদিন ধরে কমিটি ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড না থাকায় নতুন কমিটির পদপ্রত্যাশীরা নেতৃত্ব পাওয়ার আগেই বয়সের কারণে অযোগ্য হয়ে পড়ছেন।

ছাত্রনেতারা এখন কে কোথায় : বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের ছয় বছরের ‘বুড়ো’ কমিটির সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক হাসিবুল হাসান সুরুজ। তিনি এখন কাহালু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। ১ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুর ইসলাম তাইজুল ছিলেন বগুড়া সদর উপজেলার নুনগোলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য (মেম্বার)। জনপ্রতিনিধির পদের পাঠ চুকিয়ে এখন তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করছেন। ৮ নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীম পোদ্দার করছেন মিডল্যান্ড ব্যাংকে চাকরি। ১৫ নম্বর সদস্য আসিফ হাসান সিজান নৌ প্রকৌশলী ছিলেন। চাকরির সুবাদে এত দিন নানা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন, জেলা কমিটির কোনো কাজে সক্রিয় না থাকলেও এখন নতুন নেতৃত্বের বড় পদ বাগাতে ঢাকায় বসে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তদবির বাজিতে ব্যস্ত রয়েছেন তিনি। ক্রীড়া সম্পাদক মেহেদী হাসান হত্যা ও চাঁদাবাজি মামলার আসামি। সহসভাপতি মেহেদী হাসান (২) ব্যবসা করেন হকার্স মার্কেটে। শাহ সুলতান কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষ ভাঙচুর ও মারামারির ঘটনায় আরেক সহসভাপতি আরিফুল আলম হয়েছিলেন দল থেকে বহিষ্কার। উপ-অর্থ সম্পাদক হোসেন আলী রাব্বি পুলিশের এসআই পদে যোগ দিয়েছেন। উপ পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক ইমরান আলী রনি বর্তমানে জেলা যুবলীগের উপদপ্তর সম্পাদক। সহসম্পাদক ওসমান গনি শুভ বগুড়া পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে প্রকাশ্যে দরপত্র বাক্স ছিনতাই মামলার আসামি। এই অভিযোগে দুই মাসের বেশি হাজতবাস করতে হয়েছে তাঁকে। সাংগঠনিক সম্পাদক তাজমিলুর রহমান তমাল নেমেছেন বালু ব্যবসায়। তাঁর নামে রয়েছে মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের মামলাও। মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক সাজু মিয়া ও উপ-ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক মনিরুজ্জামান সাব্বির হন হত্যা মামলার আসামি। আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত কুমার দাস ছিলেন যুবলীগ নেতা। যুবলীগ করার পর ছাত্রলীগে পদ পাওয়ার কোনো নিয়ম না থাকলেও সে সময় তিনি বড় পদ বাগিয়ে নেন। অতীতে ছাত্রলীগের কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ না নিলেও দপ্তর সম্পাদক হয়েছিলেন ফয়সাল আহম্মেদ। আয়নাল হক নয়ন জেলা কমিটির সহসভাপতি পদে থেকেই স্বেচ্ছাসেবক লীগে সদস্য পদে গেছেন। ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক রুমানা আজিজ রিংকি এখন জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যও। উপশিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক হারুনুর রশিদ রাফির অবস্থাও একই। তিনিও ছাত্রলীগের পদে থেকেই হয়েছেন জেলা শ্রমিক লীগের দপ্তর সম্পাদক। এ ছাড়া সদস্য মোজাম্মেল হোসেন ও গোলাম রাব্বিকে জেলা কমিটির বেশির ভাগ নেতাকর্মীই চেনেন না।

বিয়ের পিঁড়িতে ৩৮ নেতা : নাইমুর রাজ্জাক তিতাস ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি। বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। এখন এক সন্তানের জনক। তাঁর পথেই হেঁটেছেন আরো ৩৭ নেতা। তাঁরা হলেন সহসভাপতি সনত্ কুমার সরকার, আব্দুস সবুর, শিপলু শেখ, রাজিব হাসান খান, সজীবুল ইসলাম সবুজ, আয়নাল হক নয়ন, ফরিদুল ইসলাম, আবু শাহিন, আসলাম হোসেন, মেহেদী হাসান, আমিনুল ইসলাম, আহসান হাবীব বাবুল ও মাহমুদুল হাসান। এ ছাড়া যুগ্ম সম্পাদক নুর ইসলাম তাইজুল ও মোস্তাফিজার রহমান ফিজু। সাংগঠনিক সম্পাদক জিহাদ আল হাসান জুয়েল, সোহেল মাহমুদ ও তাজমিলুর রহমান তমাল। এ ছাড়া বিয়ে করে সংসারি হয়েছেন উপদপ্তর সম্পাদক মুরাদ হোসেন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক হাসিবুল হাসান সুরুজ, উপপাঠাগার সম্পাদক আজমীর হোসাইন, ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক রুমানা আজিজ রিংকি, উপ-ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদক নিলুফা ইয়াসমিন। গাঁটছড়া বাঁধার তালিকায় আরো রয়েছেন নাট্য ও বিতর্ক সম্পাদক মেহেদী হাসান মানিক, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক মশহুর-ই-আলম অয়ন, গণযোগাযোগ সম্পাদক রাহিমুল হাসান জীম, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক তপু চন্দ্র দেবনাথ, কৃষি শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আবু হাসান রনি, সহসম্পাদক তরিকুল ইসলাম ও শাহিনুর ইসলাম। সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন আতাউর রহমান আতা, মোজাম্মেল হোসাইন বুলবুল, বিশ্বজিত্ কুমার সাহা, জাকিউল আলম জনি, নাহিদ হাসান, ইবনে সাউদ, সেলিম রেজা ও রাশেদুজ্জামান মিথুন।

নেতারা কে কী বলছেন : বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসাদুর রহমান দুলু বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি নিয়ে যা হচ্ছে তা ছাত্রলীগের আদর্শের সঙ্গে যায় না। যথাসময়ে সম্মেলন না হওয়া এবং কোন্দলের কারণে তাকবীরের মতো নেতাদের প্রাণ দিতে হয়েছে। এখন সম্মেলনের মাধ্যমে জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

গুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাইমুর রাজ্জাক তিতাস বলেন, ‘সাংগঠনিক পরিবেশ অনুকূলে না থাকায় সম্মেলন করা সম্ভব হয়নি। যাঁরা ছাত্রলীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সংগঠনে গেছেন, তাঁরা ছাত্রলীগে থাকতে পারবেন না। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত এই সমস্যা সমাধানের।’

জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম কুমার রায় বলেন, কেন্দ্রের নির্দেশনা পেলে সম্মেলনের ব্যবস্থা করা হবে। দীর্ঘদিন হয়ে যাওয়ায় এখন দলীয় কর্মকাণ্ডে অনেকের মনোযোগ নেই। তাঁরা নিজেরাও চাইছেন দ্রুত সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি দেওয়া হোক।

নতুন নেতৃত্বে আসতে চান যাঁরা : বগুড়ায় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হলে সেখানে সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়ার জন্য ডজনখানেক নেতা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন প্রচার সম্পাদক মুকুল ইসলাম, যুগ্ম সম্পাদক মিথিলেস প্রসাদ, সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুজ্জামান মৃদুল ও তোফায়েল আহম্মেদ তোহা; সহসভাপতি আরিফুল আলম শাওন, শহর কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ ফারহান অরচি, যুগ্ম সম্পাদক সাজ্জাদ আলম পারভেজ, গণশিক্ষা সম্পাদক সজীব সাহা, সদস্য আতিকুর রহমান, তৌহিদ আলম, মিনহাদুজ্জামান সজল, সেভিট মণ্ডল, আসিফ হাসান সিজান, মাহফুজার রহমান ও আবু বক্কর সিদ্দিক রাসেল।

অন্য ইউনিটগুলোরও একই হাল : বগুড়ায় ছাত্রলীগের ইউনিট রয়েছে ১৯টি। এর মধ্যে শুধু গাবতলী, কাহালু ও নন্দীগ্রামে গঠিত কমিটিগুলোর মেয়াদ রয়েছে। অন্য ১৬টি ইউনিটের মধ্যে বগুড়া পৌর, সোনাতলা নাজির আখতার সরকারি কলেজ, গাবতলী সরকারি কলেজ এবং সান্তাহার সরকারি কলেজের কমিটি দীর্ঘদিন ধরে স্থগিত। বাকি ১২টি ইউনিটই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ।

ছাত্রলীগের সরকারি আজিজুল হক কলেজ কমিটিও মেয়াদোত্তীর্ণ। সম্মেলন ছাড়াই ২০১৬ সালের ৪ নভেম্বর এই শাখার কমিটি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র। কে এম মোজাম্মেল হোসেনকে সভাপতি ও আব্দুর রউফকে করা হয় সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তী সময়ে সেখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি তাঁরা। এরই মধ্যে সাধারণ সম্পাদক রউফ সহকর্মী জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক তাকবীর ইসলাম খান হত্যা মামলায় প্রধান আসামি হয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। মেয়াদোত্তীর্ণ বগুড়া শহরের সরকারি শাহ সুলতান কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি পরে পুনর্গঠনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাঁচ বছর ধরে সেখানকার কার্যক্রম স্থবির। ভর্তি বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ায় ২০১৬ সালের ৩০ জুন সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। এরপর থেকে সেখানেও ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই।

https://www.kalerkantho.com/online/country-news/2021/06/01/1038704