অনুমোদন নেই, লাইসেন্স নেই। নেই ব্যাবসায়িক অ্যাকাউন্টও। তার পরও ৭৫০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ধামাকা শপিং ডটকমে। আরেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ রাসেলকে সস্ত্রীক গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, গ্রাহক ও সাপ্লাইয়ারদের তাঁর কাছে হাজার কোটি টাকারও বেশি পাওনা আছে। ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জের পর প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ধামাকা শপিং ডটকমের সিওও সিরাজুল ইসলাম রানাসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এই তিন প্রতিষ্ঠানের পর আলেশা মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদীনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডির মতো ৯টি প্রতিষ্ঠানকে নজরদারিতে রেখেছে সরকার।

kalerkantho

ই-ক্যাব বলছে, গত মার্চ থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত আলোচিত ই-কমার্সগুলোতে ছয় হাজার ৭০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর পরের কয়েক মাসে লেনদেন হয়েছে ৪৯০ কোটি টাকা। আর ‘পঞ্জি’ (কম বিনিয়োগে বেশি মুনাফার প্রতিশ্রুতি) মডেলের মাধ্যমে যে ব্যবসাগুলো হচ্ছিল, সেগুলো থেমে গেছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যুবক, ডেসটিনি, ইউনিপের মতো এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) কাণ্ডে টাকা খুইয়ে আইনি দীর্ঘসূত্রতায় এখনো টাকা ফিরে পাননি অনেক গ্রাহক। ই-কমার্স খাতেও হারানো টাকা ফিরে পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না কেউ। আবার টাকা ফিরে পেতে যে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে তাতেও ত্রুটি আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বেশির ভাগ মামলা ফৌজদারি আইনে হচ্ছে, যাতে টাকা ফিরে পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

ই-অরেঞ্জ থেকে ৭০ লাখ টাকার পণ্যের অর্ডার দেন দিনাজপুরের বিরামপুরের আব্দুল বারেক। পাবনার চাটমোহরের আমিনুল ইসলাম দিয়েছেন ৪০ লাখ টাকা। রাজধানীর গুলশানের ওয়াহেদুল আলম বিনিয়োগ করেছেন ৪৭ লাখ টাকা। ই-অরেঞ্জের কর্তাব্যক্তিরা গ্রেপ্তার ও কার্যক্রম বন্ধ হওয়ায় তাঁরা কেউ পণ্য বা টাকা কোনোটিই ফেরত পাননি। তাঁদের মতো ৩৩ জন গ্রাহক আলোচিত এই ই-কমার্সে পণ্য ক্রয়ের জন্য বিনিয়োগ করা ১৬ কোটি টাকা ফেরতের নির্দেশনা চেয়ে সম্প্রতি হাইকোর্টে রিট দায়ের করেছেন।

ই-অরেঞ্জের পর আরেক আলোচিত ই-কমার্স ইভ্যালি একজন গ্রাহককে অর্ডার বুঝিয়ে না দেওয়া ও টাকা ফেরত না দেওয়ায় তিনি ইভ্যালির বিলুপ্তি চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতেই ইভ্যালির সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর করা যাবে না বলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন হাইকোর্ট।

আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর জেল-জরিমানা হবে। কিন্তু ভুক্তভোগীরা কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাবেন না। আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানি আইনে মামলা করতে হবে। কোনো কম্পানির যদি মূলধন থেকে দেনা বেশি হয়ে যায় এবং ওই কম্পানি যদি আয় থেকে দেনা পরিশোধ করতে পারবে না এমন দেখা যায় তখন ওই কম্পানিকে দেউলিয়া ঘোষণা করার জন্য মামলা করা যায়। দেউলিয়া ঘোষণা করলে আদালত তাদের সহায়-সম্পত্তি নিলামে তুললে ভুক্তভোগীরা আনুপাতিক হারে পাওনার কিছু অংশ পেতে পারেন।’

ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের এই শিক্ষক আরো বলেন, ই-কমার্সে প্রতারণার দায়ে আগেই মালিককে জেলে দেওয়ার চিন্তাই সবার প্রথমে মাথায় আসছে। ক্ষতিগ্রস্তরাও আইন জানেন না। ই-কমার্স কম্পানির সম্পদ নেই এমন হিসাবের মধ্যে গরমিল থাকতে পারে। কেউ ৯০০ কোটি টাকা গায়েব করে দেবে এটা সম্ভব নয়।

দেশের উদীয়মান ই-কমার্স খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সাত দফা সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। নতুন আইন কিংবা নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন না করে বরং সরকারের উচিত হবে বিদ্যমান যেসব আইন আছে সেগুলো বাস্তবায়নে নজর দেওয়া; একই সঙ্গে সরকারের এক সংস্থার সঙ্গে আরেক সংস্থার সমন্বয় করা।

ই-অরেঞ্জের ভুক্তভোগীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির গণমাধ্যমকে বলেন, রিটে ভুক্তভোগী গ্রাহকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়ার পাশাপাশি গ্রাহক ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ ও সুষ্ঠু পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়ার জন্য অর্থনীতিবিদ, তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এ ছাড়া ই-অরেঞ্জসহ অন্যান্য অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানসমূহে রিসিভার নিয়োগ, অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের আবেদন করা হয়েছে। অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে মানি লন্ডারিং হয়েছে কি না তা তদন্ত করতে আবেদন জানানো হয়েছে রিটে।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন গতকাল বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণামূলক আচরণের কারণে খাতটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এসব ভুয়া প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার ভোক্তার টাকা আছে। অন্যদিকে ই-কমার্স সেক্টরের ওপর গ্রাহকদের আস্থাও নষ্ট হয়েছে। এই অবস্থায় বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধান সংশোধন করা উচিত এবং প্রতারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে; পর্যাপ্ত, দক্ষ মানবসম্পদ এবং প্রযুক্তি উদ্যোগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষেও পুরো টাকা আসলে ফেরত পাওয়া যাবে না। অরিয়েন্টাল ব্যাংকের মতো অর্গানাইজড সেক্টর যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারিতে ছিল, সেখান থেকেও মানুষ টাকা ফেরত পায়নি। যুবক, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠান থেকেও টাকা ফিরে পাননি গ্রাহকরা। ই-কমার্স খাত থেকেও টাকা উদ্ধার করা কঠিন হবে।

আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, ই-কমার্সের জন্য দেশে নতুন করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা চাই না। ই-কমার্সে শৃঙ্খলা আনতে হলে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে আরো কার্যকর করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটিকে জবাবদিহি করা এখন সময়ের দাবি। প্রয়োজনে তাদের শক্তিশালী করতে হবে। তিনি আরো বলেন, ই-কমার্স নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় ভূমিকা ছিল।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আইনগত সীমাবদ্ধতা আছে। তারা তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী করছে। তবে তাদের সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে।

তিনি বলেন, যেসব ই-কমার্স কম্পানির কর্মকর্তাকে ধরা হচ্ছে তাঁরা আরো ব্যবসা করে মানুষকে ঠকিয়ে হয়তো কিছু মানুষকে টাকা দিতেন। তাঁদের ধরা হচ্ছে যাতে আর চুরি করতে না পারেন এবং অন্যরাও চুরি করার সুযোগ না পান। যাঁরা প্রতারণা করছেন তাঁদের আইনের আওতায় আনতে হবে। এই ধরনের অনৈতিক ব্যবসার সুযোগ প্রথম থেকেই দেওয়া উচিত হয়নি। তাঁরা সম্পদ হয়তো সরিয়েছেন। মানি লন্ডারিং করেছেন কি না তদন্ত করে দেখতে হবে।

এদিকে ইভ্যালি, ধামাকাসহ চার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদ স্থগিত করেছে ই-কমার্সভিত্তিক ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব)। অন্য দুটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সিরাজগঞ্জ শপডটকম ও গ্লিটার্সআরএসটি ওয়ার্ল্ড।

ই-ক্যাব জানায়, ভোক্তা ও বিক্রেতাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ই-ক্যাব ১৬টি প্রতিষ্ঠানকে ভিন্ন ভিন্ন অভিযোগে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। এর মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে জবাব না দেওয়া, সন্তোষজনক জবাব না দেওয়া, ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১ পরিচালনা না করা এবং ক্রেতা-ভোক্তাদের পাওনা সময়মতো পরিশোধ না করার কারণে এই চার প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদ স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে গত ১৮ আগস্ট আরো চার প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদ স্থগিত করেছিল ই-ক্যাব।

জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম শোভন গতকাল বলেন, ‘মামলা বা গ্রেপ্তার করলে টাকা পাওয়া যাবে যদি টাকা তহবিলে থাকে। আবার যাঁদের সম্পদ আছে তাঁদের ক্ষেত্রে হয়তো সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেও গ্রাহকের টাকা দেওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু তহবিল না থাকলে প্রচলিত ব্যবস্থায় টাকা পাওয়ার পথ নেই। তাই বিকল্প চিন্তা করা যেতে পারে। আইনি প্রক্রিয়া এবং গ্রাহকের সমস্যার সমাধান দুটোর কোনো সমাধান বের করা যায় কি না সেটা ভেবে দেখা যেতে পারে।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক হাফিজুর রহমান গতকাল বলেন, ‘যাঁদের টাকা পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে আছে তাঁদেরটা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যাঁরা আগে টাকা দিয়েছেন, গেটওয়েতে যাঁদের টাকা নেই তাঁদের ব্যাপারে আদালত যেভাবে নির্দেশনা দেবে আমরা সেভাবে কাজ করব। যদি ই-কমার্স মালিকরা টাকা এমন জায়গায় নিয়ে থাকেন যেখান থেকে টাকা উদ্ধার করা সম্ভব না তাহলে কঠিন হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে যে ৯টি ই-কমার্স কম্পানির তথ্য চেয়েছিলাম তা এখনো পাইনি।’

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সুযোগ নিয়ে মানুষের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। এটা সরকারের নজরে এসেছে। বাণিজ্য, অর্থ ও আইন মন্ত্রণালয় এই জালিয়াতি নিয়ে সরাসরি কাজ করছে। সমস্যাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ক কমিটিকে আরো শক্তিশালী করা হচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করা হবে। শুধু লাভ নয়, সব দিক বিবেচনা করে যেন মানুষ বিনিয়োগ করেন। ভোক্তারা যেন বঞ্চিত না হন, লোকসানে না পড়েন। তবে কোনো অবস্থায় ই-কমার্সের এই প্রসার স্থবির হয়ে পড়ুক এটা সরকার চায় না। কারণ তৃণমূলের অনেকে এই ব্যবসা করে বেঁচে আছেন। এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যাঁরাই ব্যবসা করুন, তাঁদের একটি কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের আওতায় আসতে হবে। তিনি বলেন, প্রতারণায় জড়িত ইভ্যালি ও অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর কী পরিমাণ সম্পদ আছে, সেগুলোও খতিয়ে দেখতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের কতটা ক্ষতিপূরণ দেওয়া যায়। বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করবে কমিটি। আইন মন্ত্রণালয় এর প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে।

তবে ই-কমার্স খাত বিকশিত হলেও এই খাত তদারকি ও নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়েনি বলে মনে করছেন ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল। তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে ই-ক্যাবের প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালে ই-কমার্স নীতিমালা হয়। সেখানে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার জন্য সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া ছিল। সেন্ট্রাল কো-অর্ডিনেশন সেল গঠন, টেকনিক্যাল কমিটি, রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটি করার কথা বলা ছিল। কিন্তু সেগুলো এখনো হয়নি।