দেশের মাধ্যমিক শিক্ষায় নিয়োগ, বদলি, এমপিওভুক্তি, পরিদর্শন, পাঠদান অনুমোদন, স্বীকৃতি নবায়নসহ প্রায় সব কাজেই পদে পদে ঘুষ লেনদেন হয়। অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। নিয়মবহির্ভূতভাবে এই টাকা দিতে হয় স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, গভর্নিং বডি বা বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় এই চিত্র উঠে এসেছে।

‘মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়ন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন গতকাল বুধবার টিআইবি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে।

kalerkantho

গবেষণা প্রতিবেদনে বিভিন্ন খাতভিত্তিক অনিয়ম ও দুর্নীতির ব্যাপারে বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগে সাড়ে তিন লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, বিদ্যালয়ের গভর্নিং বডি বা পরিচালনা কমিটির সদস্যরা এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সুপারিশ করা সহকারী শিক্ষককে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগদানের সময় ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা এই টাকা নেন। সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগে দু-তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। এর সঙ্গেও জড়িত প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা।

শিক্ষক এমপিওভুক্তিতে পাঁচ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই টাকা দিতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন ও নিরীক্ষার সময় সব শিক্ষকের এক মাসের এমপিওর সমান পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক ‘পরিদর্শনে অডিটর আসছে’ বলে শিক্ষকদের মধ্যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং পরিদর্শককে ‘ম্যানেজ’ করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নেন।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করা প্রতিষ্ঠান বলেছে, খোদ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এক হাজার ৫৭৭ জন শিক্ষক নিবন্ধন সনদ, কম্পিউটার ও অন্যান্য একাডেমিক সনদ ইত্যাদি জালিয়াতির মাধ্যমে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে।

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানের অনুমোদন পেতেও ঘুষ দিতে হয় এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত। এই টাকা যায় মধ্যস্বত্বভোগী, বোর্ড বা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর পকেটে। স্বীকৃতি নবায়নেও পাঁচ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। এই টাকা দিতে হয় বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক বদলিতে এক লাখ থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। মধ্যস্বত্বভোগী ও মাউশির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এই টাকার ভাগ পান।

এমপিওভুক্তির ব্যাপারে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে চারটি স্থানে ‘হাদিয়া বা সম্মানী’ দিয়ে এমপিওভুক্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষক বা অধ্যক্ষ আবেদনকারী শিক্ষকের সঙ্গে চুক্তি করেন। এ ছাড়া প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও নিয়মবহির্ভূত টাকার বিনিময়ে এমপিওভুক্তির অভিযোগ রয়েছে।

শিক্ষক বদলির ব্যাপারে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিবিধিমালা অনুযায়ী তিন বছর পর পর বদলির বিধান থাকলেও তা নিয়মিত করা হয় না। তদবির ও নিয়মবহির্ভূত টাকা লেনদেনের মাধ্যমে বদলি বা পছন্দনীয় স্থানে দীর্ঘদিন অবস্থানের অভিযোগ রয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে সংসদ সদস্য বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তির হস্তক্ষেপে সভাপতি মনোনীত করা হয়। এতে অনেকাংশে যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সম্পৃক্ত হতে পারেন না। কমিটির সভাপতি বা সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার বাধ্যবাধকতা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে অশিক্ষিত লোক অন্তর্ভুক্ত হয়।

মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমের বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অতি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, ইউনেসকোর সুপারিশ অনুযায়ী জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিসহ ২০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।

টিআইবি তাদের গবেষণার জন্য দেশের ১৮টি উপজেলার ৫৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (প্রতি উপজেলায় দুটি বেসরকারি এমপিওভুক্ত ও একটি সরকারি) থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে। ২০১৯ সালের মে-অক্টোবর পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ পর্যন্ত পরোক্ষ উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়।

প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষক তাসলিমা আক্তার এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক (আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ অনুষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ গবেষণার সুপারিশগুলোর বিষয়ে গুরুত্ব দেবে বলে তাঁরা আশা করেন।