► কেনার পর দেওয়া হতো না প্রতিশ্রুত অর্থ
► চক্রটির সদস্যসংখ্যা ১৫ থেকে ২০
ফেসবুকের মাধ্যমে কিডনি বেচাকেনায় জড়িত থাকার অভিযোগে একটি চক্রের পাঁচ সদস্য র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। র্যাবের অভিযোগ, অর্থের লোভ দেখিয়ে চক্রটি হতদরিদ্র লোকদের কিডনি সংগ্রহ করে বিত্তশালী রোগীদের কাছে বিক্রি করত। তারা কিডনি দাতা ও গ্রহীতাকে ভারতে নিয়ে কিডনি সংগ্রহ ও প্রতিস্থাপনের কাজ সম্পন্ন করত। একজন কিডনিগ্রহীতার কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নিলেও তারা কিডনিদাতাকে প্রতিশ্রুতির চার লাখ টাকার মধ্যে দুই লাখ টাকাও দিত না। এভাবে শতাধিক কিডনি বেচাকেনা করেছে তারা।
সোমবার মধ্যরাত থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত রাজধানীর নদ্দা ও জয়পুরহাট জেলায় অভিযান চালিয়ে এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ, সহযোগী মেহেদী হাসান, সাইফুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান ও তাজুল ইসলাম ওরফে তাজু। তাঁদের মধ্যে ইমরান চক্রটির হোতা। এ ছাড়া মান্নান ও তাজুল আগেও একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জয়পুরহাটের কালাই থানায় এসংক্রান্ত একটি মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি জানান, র্যাব-৫, র্যাব-২ ও র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখার যৌথ অভিযানে এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে ভুক্তভোগী কিডনিদাতাদের চারটি পাসপোর্ট, ভিসা ও চিকিৎসা সম্পর্কিত বেশ কিছু কাগজপত্র এবং পাঁচটি মোবাইল ফোন ও দেশি-বিদেশি মুদ্রা জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র্যাব জানায়, চক্রটির মোট সদস্যসংখ্যা ১৫ থেকে ২০। তারা তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করে। প্রথম দলটি ঢাকায় অবস্থান করে ফেসবুকের মাধ্যমে কিডনি প্রতিস্থাপন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের খুঁজে বের করে। দ্বিতীয় দলটি প্রথম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আর্থিক দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে হতদরিদ্র মানুষের টাকার বিনিময়ে কিডনি ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে। এতে কেউ রাজি হলে তাকে ঢাকায় আনা হতো। তৃতীয় দলটি ডোনার হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিটিকে ঢাকার বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে কিডনিগ্রহীতার সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য পরীক্ষা সম্পন্ন করে। এসব পরীক্ষায় কিডনি প্রতিস্থাপনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে তার পাসপোর্ট, ভিসাপ্রক্রিয়া ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভুক্তভোগী ডোনারকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, ‘বাংলাদেশ কিডনি ও লিভার প্যাশেন্ট চিকিৎসাসেবা’ এবং ‘কিডনি লিভার চিকিৎসাসেবা’ নামক দুটি ফেসবুক পেজের অ্যাডমিন হচ্ছেন ইমরান। ফেসবুক পেজ থেকে ‘এ-প্লাস ডোনার প্রয়োজন, পাসপোর্টসহ ১০ দিনের মধ্যে ফ্লাইট হবে ইনশাআল্লাহ’ এবং ‘একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে জরুরি বি-প্লাস লিভার ডোনার প্রয়োজন, পাসপোর্টসহ কেউ থাকলে ইনবক্সে আসুন, আর্জেন্ট লাগবে’—এ ধরনের পোস্টের মাধ্যমে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তারা।
কিডনিদাতাদের ভারতে পাঠানোর পর তাদের সে দেশের বিমানবন্দর বা স্থলবন্দরে এসে নিয়ে যায় সেখানকার আরেকটি চক্র। তারা হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ভিকটিমকে বৈধ ও অবৈধ উপায়ে দেশে ফেরত পাঠাত।
কমান্ডার মঈন বলেন, প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তারা রোগীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করত। বিপরীতে তারা কিডনি ডোনারকে তিন থেকে চার লাখ টাকা দেওয়া হবে বলে আশ্বস্ত করে অগ্রিম দুই লাখ টাকা প্রদান করত। কিডনি প্রতিস্থাপনের পর প্রলোভনের শিকার কিডনিদাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে নানা রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করত। চক্রের হোতা ইমরান প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপন বাবদ পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং মান্নান ও তাজুল প্রতি কিডনিদাতা সংগ্রহ বাবদ যথাক্রমে পাঁচ ও তিন লাখ টাকা করে নিতেন। আইনের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা কোনো ধরনের রসিদ, পাসপোর্ট বা অন্য কোনো প্রমাণপত্র ভুক্তভোগী ডোনারকে দিতেন না।
মঈন বলেন, চক্রের হোতা শাহরিয়ার ইমরান আহম্মেদ পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানরত কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের সঙ্গে মিলে চক্রটি গড়ে তোলেন। তাঁদের মধ্যে আব্দুল মান্নান মূলত কিডনি ডোনারদের অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধ কাজটিতে প্রলুব্ধ করেন। তিনি আগেও এই অপরাধের জন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে ছয়টির বেশি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তার তাজুল ইসলাম মান্নানের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন এবং তাঁর বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা রয়েছে।