জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) লিডার সামিটে দেওয়া বক্তব্যে উন্নত বিশ্বের দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণসহ চার দফা দাবি পেশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টানার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের বিভিন্ন উদ্যোগও তুলে ধরেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরিবেশ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ১২ বিলিয়ন ডলারের ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বাতিল করেছে।
শেখ হাসিনা গতকাল সোমবার স্থানীয় সময় বিকেলে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) মূল পর্বে লিডার সামিটে বক্তব্য দেন। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সোচ্চার ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম-সিভিএফ’-এর সভাপতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বনেতাদের সামনে চারটি দাবি তুলে ধরেন।
প্রথম দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রধান কার্বন নিঃসরণকারীদের অবশ্যই উচ্চাভিলাষী জাতীয় পরিকল্পনা (এনডিসি) দাখিল এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
দ্বিতীয় দাবিতে শেখ হাসিনা বলেন, উন্নত দেশগুলোকে অভিযোজন এবং প্রশমনে অর্ধেক অর্ধেক (৫০ঃ৫০) ভিত্তিতে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর তৃতীয় দাবিতে বলা হয়, উন্নত দেশগুলোকে স্বল্প খরচে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে।
চতুর্থ দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার মতো দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের দায়িত্ব নেওয়াসহ জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ক্ষতি ও ধ্বংস মোকাবেলা করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনে নগণ্য অবদান রাখলেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বৈশ্বিক মোট কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের দায় ০.৪৭ শতাংশের চেয়েও কম। অথচ বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি।
জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ২০০৯ সালে ‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করার কথা উল্লেখ করেন টানা তিনবারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গত সাত বছরে আমরা জলবায়ুসংক্রান্ত ব্যয় দ্বিগুণ করেছি। বর্তমানে আমরা জাতীয় অ্যাডাপটেশন প্ল্যান তৈরি করছি।’ সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার একটি উচ্চাভিলাষী ও হালনাগাদ জাতীয় নির্ধারিত পরিকল্পনা পেশ করেছে বলে জানান তিনি।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ জ্বালানি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম স্থানীয় সৌরবিদ্যুৎ কর্মসূচিগুলোর একটি বাংলাদেশে রয়েছে। জলবায়ু বিপদগ্রস্ত দেশ থেকে জলবায়ুসহিষ্ণু এবং সেখান থেকে জলবায়ু সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে বাংলাদেশ ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের পরিবেশগত বিপর্যয় প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ১১ লাখ রোহিঙ্গার কারণে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়ছে, তার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলারও চেষ্টা করছে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম-সিভিএফ এবং ভি-২০ চেয়ার হিসেবে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত ৪৮টি দেশের স্বার্থের বিষয়গুলো তুলে ধরছি। আমরা ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ার অফিস গ্লোবাল সেন্টার অব অ্যাডাপটেশনের মাধ্যমে আঞ্চলিকভাবে আমাদের সেরা অনুশীলন এবং অভিযোজন জ্ঞান বিনিময় করছি। সিভিএফের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ একটি ক্লাইমেট ইমার্জেন্সি চুক্তি করার চেষ্টা করছি।’
সিভিএফ-কমনওয়েলথ প্যানেল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী
লিডার সামিটের আগে গ্লাসগোতে কপ-২৬ সম্মেলনের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত ‘ক্লাইমেট প্রসপারিটি পার্টনারশিপ’ বিষয়ে সিভিএফ-কমনওয়েলথ উচ্চ পর্যায়ের প্যানেল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। তিনি এতে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পৃথিবীকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াল পরিণাম থেকে বাঁচাতে কমনওয়েলথ এবং ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামকে (সিভিএফ) এক সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে একটি বাস্তবসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান খুঁজে বের করার তাগিদ দেন তিনি।
স্থানীয় সময় গতকাল সকালে অনুষ্ঠিত প্যানেল আলোচনায় জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর সংগঠন সিভিএফের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এখন বৈশ্বিক এবং আন্তঃসীমান্ত সমস্যা। জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্ষতিকর প্রভাব জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অপরিবর্তনীয় ক্ষতির শেষ প্রান্তে নিয়ে এসেছে।
সিভিএফের এক-তৃতীয়াংশ দেশ কমনওয়েলথেরও সদস্য—এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে অনুঘটক হিসেবে সিভিএফ এবং কমনওয়েলথ একসঙ্গে কাজ করতে পারে।’ উভয়ের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতার জন্য ছয়টি সুপারিশ উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রথম সুপারিশে রয়েছে সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য টেকসই, সবুজ ও প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান অর্জনে জ্ঞান, গবেষণা, সক্ষমতা তৈরি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা।
দ্বিতীয় সুপারিশে প্রধানমন্ত্রী প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত দেশগুলোর বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে সবাইকে সম্মিলিত অবস্থান নিতে বলেন। তৃতীয় সুপারিশে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বিষয়টি উত্থাপন করে শেখ হাসিনা বলেন, তাদের পুনর্বাসনে বিশ্বের দায়িত্ব রয়েছে।
চতুর্থ সুপারিশে বলা হয়, সবার ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ প্রধান গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশগুলোকে উচ্চাভিলাষী এবং আগ্রাসী জাতীয় পরিকল্পনা ঘোষণা করতে চাপ হিসেবে কাজ করতে পারে।
পঞ্চম সুপারিশে শেখ হাসিনা জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সহনীয় খরচে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি হস্তান্তর করার তাগিদ দেন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমনওয়েলথ মহাসচিব প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড।
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে যোগ দিতে রবিবার স্থানীয় সময় বিকেলে গ্লাসগোতে আসেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে বাংলাদেশ সময় রবিবার সকালে ঢাকা থেকে যুক্তরাজ্য রওনা হন তিনি।
গ্লাসগোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কপ-২৬ সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্ব এবং রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের বক্তব্য প্রদান সেশন ছাড়াও পাশাপাশি (সাইড লাইনে) অনেক ইভেন্টে অংশ নেবেন। পাশাপাশি বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবং বিভিন্ন সংস্থাপ্রধানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন তিনি। গ্লাসগো সফর শেষে কাল বুধবার দুপুরে লন্ডন রওনা হবেন প্রধানমন্ত্রী। লন্ডনে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের পর ৯ নভেম্বর দ্বিপক্ষীয় সফরে ফ্রান্স যাবেন তিনি।