ধূপ-ধুনোর ঘ্রাণ আর ঢাকের তালে তালে ৪ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। ঘোড়ায় চলে কৈলাস থেকে দেবী দুর্গা আসছেন মর্তলোকে। আর মাত্র কয়েকটা দিন। চারপাশে তাই সাজসাজ রব। গতকালই মহালয়ার ভোগ প্রদানের মধ্য দিয়ে দেবীর আগমনী বার্তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে সবাইকে। এ সময় সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন প্রতিমাশিল্পীরা। বাড়ি-বাড়ি বা পাড়ায়-পাড়ায় যে পূজামণ্ডপ সেজে উঠবে, তার মধ্যমণিকে সাজিয়ে তুলতেই কারিগরদের এত ব্যস্ততা।

রাজধানীর রায়েরবাজার, নিমতলা, শাখারিপট্টির প্রতিমা কারিগরদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেলো ব্যস্ততা। তুলির শেষ আঁচড় দিতে ব্যস্ত কারিগররা। দেবীর আবির্ভাব শরৎকালে হলেও প্রতিমা কারিগরদের কাজ শুরু হয় সেই বৈশাখের শুরু থেকেই। বর্ষাকালে বাড়ে কাজের তোড়জোর। বর্ষায় নরম মাটি সংগ্রহ করে রাখেন পালশিল্পীরা।

এই মুহূর্তে শুধু চক্ষুদান ও পোশাক ও অলঙ্কার পরানোর কাজ বাকি আছে মাত্র। কোথাও কোথাও অবশ্য রঙের কাজও বাকি আছে। শরতের বৃষ্টি কাজে বেশ বাগড়া দিচ্ছে বলে জানালেন রায়েরবাজার নিমতলা মন্দিরের কানাই পাল। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে তুলির আঁচড়ে দেবীকে সাজানোর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় তার  প্রতিমা তৈরির পথচলা।

মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রতিমা তৈরি করতে এসেছেন এই মন্দিরে। তিনি প্রতিমা তৈরি করেন প্রায় ৪৫ বছর ধরে। কানাই পাল বলেন, প্রতিমা তৈরি করা ভীষণ ধৈর্য ও মনোযোগের কাজ। যদি একবার ভুল হয়ে যায়, তাহলে আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। একটি মণ্ডপের প্রতিমা বানাতে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মাস সময় লাগে।

তার সঙ্গে কাজ করেন আরও চার জন কারিগর। মাসে তাদের বেতন দিতে হয় ৩০ হাজার টাকা। কাজ শেষে দেখা যায় হাতে তেমন কিছু থাকে না। বছরে একটা সময় প্রতিমা তৈরি করেন। পাশাপাশি সারা বছরই মাটির জিনিস তৈরি করেন তিনি। তবে বছরে একবার প্রতিমা তৈরি করে সংসার চলে না, ভীষণ অভাবে জীবন কাটাতে হয় তাদের। তাই প্রতিমা তৈরির পেশায় আসতে চাইছেন না কানাই পালের উত্তরাধিকারীরা।

বাবার সঙ্গে কাজ করতে এসেছে শংকর পাল। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে কাজ করছি আমি। তবে আমার ভাই পড়াশোনা করেছেন, এখন ব্যবসা করছেন। আমিও ভাইয়ের মতো ব্যবসা করতে চাই।

শাখারিপট্টির অশোক পাল বৃষ্টির ওপর খুব বিরক্ত। বৃষ্টি এবার কাজ ব্যাহত করছে। রঙ দেওয়ার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ করতে পারেননি। তাই ঘরের মধ্যে নইলে ছাউনিতে কাজ চলছে। প্রতিমা শুকাতে ফ্যানের বাতাস চলছে।

সময়মতো প্রতিমা না দিতে পারলে ভীষণ বকাঝকা শুনতে হয় ক্রেতাদের। কখনও কখনও হুমকিও সহ্য করতে হয় বলে জানালেন তিনি। অনেক সময় পুরো টাকাও পরিশোধ করেন না অনেকে। কেউ আবার খুশি হয়ে বখশিস দেন। চেষ্টা থাকে যেন পূজা কমিটির সময়মতোই ডেলিভারি করে ফেলা যায়। বৃষ্টি এবার বিঘ্ন ঘটিয়েছে।

অশোক পাল জানালেন, অনেক সময় আগে তৈরি করে রাখা প্রতিমাও বিক্রি করে দেন। বেশ কয়েকটি পুরনো প্রতিমা দেখা গেলো। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী রঙ ও পোশাক পালটে দেন শুধু। তবে অনেকেই এখন থিম ধরে কাজ করছেন। থিমভিত্তিক কাজগুলোর জন্য কমপক্ষে চারমাস আগে অর্ডার নেন অশোক পাল। এগুলোর দাম আলাদা, কাজেও প্রচুর সময় দিতে হয়।

শত বিঘ্নের মধ্যেই কাজ গুছিয়ে এনেছেন তিনি ও অন্য কারিগরেররা। চক্ষুদান পর্বই কেবল বাকি। আয়োজকদের পছন্দমতো চক্ষুদান করা হবে। অশোক পালের বাবাও এই কাজ করতেন। আর্থিক সংকট থাকার পরও ভালোলাগার কারণেই কাজটা ছাড়তে পারেননি তিনি। 

এভাবেই হাজারও সমস্যা মধ্যে দিয়ে প্রতিটি দুর্গাপুজা পার করেন হাজারো পালেরা। তাদের খবর কেইবা রাখে। দিন শেষে সন্তুষ্টি শুধু পুণ্যার্থীদের প্রশংসা।