মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার কর্মসূচি বা মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমে (এমএম ২ এইচ) অংশ নিয়েছেন যুবলীগ ঢাকা দক্ষিণের গ্রেপ্তার হওয়া সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। সেখানে তাঁর বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও বিভিন্ন ব্যাংকে লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এ তথ্যের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে। ফলে অর্থপাচার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা হতে পারে ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে। দুদকের একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, মালয়েশিয়ার আমপাং তেয়ারাকুন্ডে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কয়েকটি ব্যাংকে সম্রাট যে লেনদেন করেছেন সে তথ্যও এখন দুদকের হাতে। দুদকের অনুসন্ধানের সময় পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগ, বিএফআইইউ, পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, সেকেন্ড হোমের এজেন্ট, মালয়েশিয়ান হাইকমিশন অনুমোদিত বিভিন্ন ভিসা এজেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য, পাসপোর্টের কপি, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে অনুমোদনপ্রাপ্তদের অনুমোদনপত্রের কপি ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী যাচাই-বাছাইয়ে সম্রাটের মালয়েশিয়ায় অর্থ পাচার ও ফ্ল্যাট থাকার তথ্য বেরিয়ে এসেছে বলে জানা গেছে।
২০০২ সালে চালু হওয়া এমএম ২ এইচ হলো এমন একটি কর্মসূচি, যেখানে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দিয়ে অন্য দেশের একজন নাগরিক মালয়েশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি বসবাস ও অন্যান্য সুবিধা পান। বিভিন্ন দেশ থেকে এ কর্মসূচিতে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৪২ হাজার ২৭১ জন অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশির সংখ্যা চার হাজার ১৩৫ জন।
এ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। আর প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে চীন ও জাপান।
বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় নিবাস গড়তে বৈধভাবে অর্থ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৪৭ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা এক সার্কুলারে দেশের বাইরে কোনো স্থাবর সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ফলে সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে যাঁরা অংশ নিয়েছেন তাঁরা টাকা পাচার করেছেন।
বাংলাদেশিরা সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শুরু করে ২০০৩ সাল থেকে। ওই বছর ৩২ জন বাংলাদেশি এতে অংশ নেয়। পরের বছর সংখ্যাটি ৬ গুণ বেড়ে ২০৪ জনে উন্নীত হয়। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে অংশ নেয় ২০০৫ সালে। ওই বছর অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ৮৫২ জন। এরপর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমে অংশ নেওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা বছরে ১০০ জনের কম ছিল। পরে তা বেড়ে যায়। ২০১৬ সালে ২৮৩ জন বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম কর্মসূচিতে অংশ নেন। পরের বছর তা দাঁড়ায় ৪৫১ জনে। অবশ্য ২০১৮ সালে এ সংখ্যা কমে গিয়ে ১৯১ জনে দাঁড়িয়েছে। সেকেন্ড হোম প্রকল্পের ওয়েবসাইট থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
পাঁচ লাখ রিঙ্গিত বা এক কোটি টাকা জমা দেওয়ার পাশাপাশি মাসে ১০ হাজার রিঙ্গিত বা দুই লাখ টাকা বৈদেশিক আয় দেখাতে পারলেই পাওয়া যায় মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ। যে কোনো দেশের নাগরিক এ প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারেন। এ জন্য স্থায়ী আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে পাঁচ লাখ রিঙ্গিত জমা রাখতে হয়। তবে দ্বিতীয় বছরে অর্ধেক অর্থ তুলে নিতে পারেন সুবিধা গ্রহণকারীরা।
অর্থ পাচার করে সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বিনিয়োগের একটি অভিযোগ ২০১৫ সালের শুরুর দিকে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। প্রথম পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু হলেও পরে এ অভিযোগের সঙ্গে অনেকের নাম পাওয়া যায়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ও বিএফআইইউ থেকে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা পাওয়া যায়।
এর মধ্যে এসবির তালিকায় ১০ হাজার ৯০৪ জন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তালিকায় ১৩ জনের নাম ছিল। দুদককে দেওয়া এসবির নথিতে বলা হয়, বিভিন্ন সময়ে ওই ১০ হাজার ৯০৪ জন মালয়েশিয়ায় যাতায়াত করেছেন। তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক। অর্থ পাচারের তথ্য-প্রমাণসহ ১৩ জনের তালিকা দিয়েছিল বিএফআইইউ।
তিন বছরের বেশি সময়ে দুদকের একাধিক টিম অনুসন্ধান করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নানা তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। সর্বশেষ উপপরিচালক (বর্তমানে পরিচালক) মো. জুলফিকার আলীর নেতৃত্বাধীন টিম অনুসন্ধান করে ১০ হাজার ৯১৭ জনের তালিকা থেকে ২৩ জনকে চিহ্নিত করে। ওই ২৩ জনের মধ্যে ১২ জনের নাম চিহ্নিত করা হয়েছে এসবির নথিপত্র যাচাই করে। বিফআইইউর নথি যাচাই করে চিহ্নিত করা হয় ১১ জনের নাম।
ওই ২৩ জনের তালিকায়ও সম্রাটের নাম ছিল। অনুসন্ধান দল তাদের প্রতিবেদনে সম্রাটসহ ওই ২৩ জনের অবৈধ সম্পদের বিষয়টি খতিয়ে দেখার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দিয়েছিল। বিনিয়োগ করা অর্থের উৎসসহ বিস্তারিত তথ্য জানতে দুদক বেশ কয়েকবার মালয়েশিয়ায় আইনগত সহায়তা অনুরোধ (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট-এমএলএআর) পাঠিয়েও সঠিক জবাব পায়নি। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পরও অজানা কারণে ওই অনুসন্ধান অনেকটা আড়ালে থেকে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব দিলোয়ার বখ্ত বলেন, অবৈধ ক্যাসিনোর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন কিংবা অর্থ পাচারের বিষয়ে যাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে সে বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান করছে। এ বিষয়ে নতুন কোনো বক্তব্য নেই বলে জানান তিনি। সচিব বলেন, অনুসন্ধান শেষেই বিস্তারিত বলা সম্ভব হবে।
অবৈধ ক্যাসিনোর মাধ্যমে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে অনুসন্ধান দল গঠন করেছে দুদক। ৩০ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে নেমেছে সংস্থাটি। তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের কাজ করছে অনুসন্ধান দলের সদস্যরা। দুদক সচিব জানিয়েছেন, অনুসন্ধান দল হাতে ইতিমধ্যে ৪৩ জনের তালিকা তৈরি করেছে। সে তালিকায়ও সম্রাটের নাম আছে প্রথম দিকে।
এরই মধ্যে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের নেতৃত্বে থাকা এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদের সঙ্গে বিশেষ বৈঠক হয়েছে দুদক চেয়ারম্যানের। বিএফআইইউ প্রধান আবু হেনা মো. রাজী হাসানও বৈঠক করেছেন দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে। দুই বৈঠকে দুদক চেয়ারম্যানের কাছে ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের নানা গোয়েন্দা তথ্য হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। সম্রাট ও তার সহযোগী আরমানকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক বাড়ি থেকে ৬ অক্টোবর গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তাঁকে ঢাকায় কাকরাইলের ভূঁইয়া ম্যানসনের কার্যালয়ে অভিযান চালানো হয়। তল্লাশি চালানো হয় শান্তিনগরে সম্রাটের ভাইয়ের বাসা ও ডিওএইচএসে সম্রাটের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাসায়। বন্য প্রাণীর চামড়া রাখার দায়ে সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। অস্ত্র এবং মাদক রাখায় সম্রাটের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে মামলা করা হয়।
উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি ডলার বা প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া এ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশে দুটি পদ্মা সেতু তৈরি করা সম্ভব। একই সময়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৭ হাজার কোটি ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যিক লেনদেনের গড়ে ১০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়।