অনুপ্রবেশ ঠেকাতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যতই কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে ততই নিত্য-নতুন কৌশল নেয়া হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রাখতে। এতদিন ধরে অনুপ্রবেশকারীদের দলে ঢুকানোর অভিযোগ চলে আসছিল নেতাদের বিরুদ্ধেই। কিন্তু এবার কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপের একটি ওয়ার্ডে এক ভিন্ন কৌশলে দলের তৃণমূলে ঢুকে পড়েছেন বহু সংখ্যক জামায়াত-বিএনপি সমর্থিত লোকজন।
এমনকি রাতারাতি করা ১৫০ জন কাউন্সিলরের মধ্যে একাত্তরের রাজাকার, জামায়াত ও বিএনপি সমর্থিত অন্তত ৫০/৬০ জনকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে যে, সেই কাউন্সিলে ব্যালটের মাধ্যমেই নির্বাচিত করা হয়েছে এক রাজাকার পুত্রকে সভাপতি এবং অপর এক বিএনপি পরিবারের সন্তানকে সাধারণ সম্পাদক। এমন কৌশলে ব্যালটের নির্বাচনটি করে রাজাকার এবং বিএনপি পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী লীগের একটি ওয়ার্ডের নেতা নির্বাচিত করা হয়েছে যে, যাতে প্রকৃত দলপ্রেমিক কর্মীরাও লজ্জায় মুখ ঢেকেছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় তোলপাড় চলছে।
অভিযোগ উঠেছে, স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বিপুল অর্থ বৈভবের মালিক হওয়ায় কাউন্সিলারদের নিকট থেকে টাকা-পয়সার বিনিময়ে সমর্থন আদায় করে নিয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র এমন কৌশল নিয়েছে যে, তারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দদের ছলেবলে বশে নিয়ে ১৫০ সদস্যের কাউন্সিলারের মধ্যে বিএনপি-জামায়াতের বিপুল সংখ্যক সমর্থকদের দলের কাউন্সিলার তালিকায় অর্ন্তভুক্ত করিয়ে নিয়েছেন।
এমনকি কাউন্সিলার তালিকার মাধ্যমে ১৯৭১ সালে যে সংখ্যালঘু পরিবারটির ঘর-দুয়ার লুঠপাট করে আগুন জ্বালিয়ে বিরান করে দেয়া হয়েছিল সেই পরিবারের সদস্যকেও ‘ব্যালট কৌশলে’ ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। মহেশখালী দ্বীপের হোয়ানক ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সেই নির্যাতিত হিন্দু প্রয়াত ডাঃ ধনঞ্জয় কুমার দে’র পুত্র তুষার কান্তি দে ২০১১ সাল থেকে দলের ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু ৩০ অক্টোবরের ‘ব্যালট কৌশলে’ তিনি পরাজিত হয়ে দল থেকে ছিটকে পড়েছেন।
গতকাল রবিবার তুষার কান্তি দে বলেন, ‘একাত্তরে যারা পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা দিয়ে আমাদের ঘরবাড়ী লুঠ করেছিল, আগুনে পুড়িয়ে আমাদের সর্বশান্ত করে দিয়েছিল সেই কুখ্যাত রাজাকার শাহাদাত কবিরের বাহিনী এবার বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগে ঢুকে গেছে। এতদিন পর ‘ব্যালট কৌশলে’ রাজাকার, জামায়াত ও বিএনপি’র কাছে আমরা আবারো সর্বশান্ত হয়ে গেছি।’ তিনি বলেন, পাকিস্তানী হায়েনাদের দোসর একাত্তরের রাজাকারদের হাতে একবার হারিয়েছিলাম বাড়ীঘর-সহায় সম্পদ আর এখন হারাতে হল দলীয় পদবী।’
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানও অকপটে স্বীকার করেছেন দলে ঢুকতে নানা দলের লোকজনের তদবিরের বিষয়টি। এ প্রসঙ্গে গতরাতে তিনি বলেন-‘সবাই এখন মরিয়া হয়ে পড়েছে আমাদের দলে আসতে। এমনকি টেকনাফ থেকে কুতুবদিয়া পর্যন্ত কক্সবাজার জেলার প্রচুর সংখ্যক লোক অঢেল টাকার বান্ডিল নিয়ে আমার পেছনেও ঘুর ঘুর করছে।’
মুজিবুর রহমান মহেশখালীর একটি ওয়ার্ডের এরকম ‘ব্যালট কৌশলে’র বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, রাতারাতি কাউন্সিলার তালিকা করে ব্যালটের নির্বাচন করা যাবে না। কেননা দলীয় সিদ্ধান্ত হচ্ছে,
কাউন্সিলার তালিকা জেলা কমিটির কাছে পাঠাতে হবে। যাচাই-বাছাই করেই চুড়ান্ত তালিকা নিয়ে করতে হবে কাউন্সিল। তিনি বলেন, রাজাকার পুত্র ও বিএনপি পরিবারের সন্তান নির্বাচিত হবার বিষয়টি দেখা হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ৩০ অক্টোবর দ্বীপের স্থানীয় টাইম বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হোয়ানক ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিল অনুষ্টিত হয়েছে। কাউন্সিল অনুষ্টান তদারকির দায়িত্বে থাকা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মীর কাশেম ও সাধারণ সম্পাদক জফুর আলমের বিরুদ্ধেই উঠেছে যতসব অভিযোগ। তবে এই দুইজন তাদের বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। মীর কাশেম ও জফুর আলম বলেন, কাউন্সিলারগনের তালিকা যারা করেছে তাদের আর কোন অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগ নেই।
জানা গেছে, দলের ওয়ার্ড কমিটিতে রয়েছেন ৫১ জন সদস্য। ১৫০ জনের কাউন্সিলার তালিকা করতে নতুন করে আরো ৯৯ জনের তালিকা করা হয়েছে। সেই তালিকায় কোনদিন আওয়ামী লীগ করেন নি এমন লোকজনকেও আনা হয়েছে। আর আওয়ামী লীগের আদর্শের বাইরে থাকা লোকজনই ব্যালট বিপ্লব ঘটিয়েছে ২০০১ সালের নির্বাচনের মত করে।
মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারি কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সহ সভাপতি এম আজিজুর
রহমান জানান, আমি দায়িত্ব পালনকালীন দীর্ঘ সময়ে হলফ করে বলতে পারব কোন অনুপ্রবেশকারিকে স্থান দিইনি। কিন্তু এখন দীর্ঘ লাইন দরে অনুপ্রবেশের জন্য। কেন্দ্র থেকে এতই হুংকার ছাড়ছে অনুপ্রবেশকারিদের স্থান না দিতে। কিন্তু কোন ভাবেই রাখা যাচ্ছে না। সবাই এখন আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়ে আখের গোছানোর তালে রয়েছে। এমন অবস্থাকে তিনি দলের জন্য অশনিসংকেত হিসাবে দেখছেন বলে জানান।
হোয়ানক ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবং প্রবীণ তৃণমূল দলীয় নেতা জালাল আহমদ বাশি অভিযোগ করে বলেন-‘ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাইফেল কাঁধে নিয়ে রাজাকার শাহাদত কবির আমাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিলেন। সেই রাজাকার ৪৮ নম্বর ক্রমিকের কাউন্সিলার।’ জালাল আহমদ বাশি বলেন, একাত্তরের রাজাকার শাহাদাতের ৪ পুত্রও ১৫০ জন কাউন্সিলারের তালিকায় অর্ন্তভুক্ত হয়েছেন। এমনকি তাদের আরো অনেক আত্মীয় স্বজন সহ বিএনপি-জামায়াতের অন্তত ৫০/৬০ জনকেই রাতারাতি কাউন্সিলার করা হয়েছে।
প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা জালাল বলেন, এমন লোকজনকেও কাউন্সিলর করা হয়েছে যারা সারা জীবন ধরে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে আসছেন। এসব লোকজনকে কাউন্সিলার করে পরের দিনই তাড়াহুড়োর মাধ্যমে কাউন্সিল অনুষ্টান করে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, ব্যালটের মাধ্যমে রাজাকার শাহাদাতের পুত্র মকছুদ আলম সভাপতি এবং বিএনপি পরিবারের সন্তান
জাহাঙ্গীর আলম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন। তবে নির্বাচিত সভাপতি মকছুদ আলম ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, প্রকাশ্যে ব্যালটের নির্বাচনে এসব কথা বেমানান।
একই ওয়ার্ডের কাউন্সিলার মোহাম্মদ ছৈয়দ অভিযোগ করেছেন, ব্যালটের নির্বাচনে জোরজবরদস্তির চাইতে কৌশল এবং বিপুল অংকের টাকা ব্যয় করেই স্বাধীনতা বিরোধীদের হাতের কব্জায় আনা হয়েছে একটি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। রাতারাতি করা হয়েছে পছন্দের লোকজন নিয়ে কাউন্সিলার তালিকা। সেই তালিকা নিয়ে তড়িঘড়ি করা হয়েছে কাউন্সিল অনুষ্ঠান।