ক্রিকেটের রূপ কত বিচিত্র। কখনো বিনোদন, উৎসব আনন্দের খোরাক। আবার কখনোবা হতাশা, দুঃখ, বেদনার সঙ্গী এই ক্রিকেট। তিন বছর আগে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ ব্যাঙ্গালুরুতে প্রাণ ভোমরা, প্রধান চালিকাশক্তি সাকিব আল হাসান ও ব্যাটিংয়ের খুঁটি তামিম ইকবালসহ মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বে পুরো শক্তির দল নিয়ে মহেন্দ্র সিং ধোনির অতি শক্তিশালী ভারতকে হাতের মুঠোয় পেয়েও হারাতে পারেনি টাইগাররা।

ভারতীয়দের ১৪৬ (৭ উইকেটে) রানে বেঁধে ফেলে ওই ছোট্ট টার্গেট নিয়ে নিশ্চিত জয়ের দোরগোড়ায় গিয়েও শেষ পর্যন্ত ১ রানের পরাজয়ের বেদনায় অশ্রু সজল চোখে মাঠ ছেড়েছিল টাইগাররা।

আজ সাকিব আর তামিম ছাড়া ভারতকে হারিয়ে দিল মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের দল। উইকেট আর ম্যাচের চালচিত্র দেখে বারবার ই ম্যাচের করুণ স্মৃতিই চোখে ভাসছিল।

সেবার প্রথম সেশনে অধিনায়ক মাশরাফি (৪ ওভারে ০/২২), সাকিব (৪ ওভারে ১/২৩), শুভাগত হোম (১/২৪), আল আমিন হোসেন (৪ ওভারে ২/৩৭) আর মোস্তাফিজুর (৪ ওভারে ২/৩৪)- কি মাপা বোলিংটাই না করেছিলেন। একদম জায়গামত বল ফেলেছেন সবাই। হাতে গোনা কটি বিচ্ছিন্ন ডেলিভারি বাদ দিলে সবাই সমীহ জাগানো বোলিং করেছিলেন।

তাদের সেই নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের বিরুদ্ধে একজন ভারতীয় ব্যাটসম্যানও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। চার ও ছক্কায় গ্যালারি গরম করা বহুদুরে, স্বচ্ছন্দে ব্যাটই করতে পারেননি।

আজকের ম্যাচের চেয়ে সেদিনের ভারতীয় ব্যাটিং ছিল অনেক বেশি সমৃদ্ধ। কে ছিলেন না? রোহিত শর্মা ১৮ (১৬ বলে), শিখর ধাওয়ান (২২ বলে ২৩), বিরাট কোহলি (২৪ বলে ২৪), সুরেশ রায়না (২৩ বলে ৩০), হার্দিক পান্ডিয়া (৭ বলে ১৫), মহেন্দ্র সিং ধোনি (১৩ বলে ১২), যুবরাজ সিং (৬ বলে ৩) আর রবীন্দ্র জাদেজার (৮ বলে ১২) মত প্রতিষ্ঠিত আর নামি-দামি পারফরমাররা মিলেও দেড়শো করতে পারেননি। ১৪৭ রানেই থেমে গিয়েছিল ভারতের ইনিংস।

জবাবে শেষ ওভারের শেষ তিন ডেলিভারিতে মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ আর মোস্তাফিজ আউট হলে ১ রানের দুঃখজনক হার থাকে সঙ্গী হয়ে।

আজ কি সেই না পারার শোধ তুলতে পারবে রিয়াদের দল? ব্যাঙ্গালুরুর চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে তিন বছর আগে না পারার সেই বেদনা কি কাটবে আজ রোববার? সেটাই ছিল দেখার।

স্কোর লাইন কিন্তু প্রায় একই। সে ম্যাচে জয়ের লক্ষ্য ছিল ১৪৭। আর আজ রিয়াদ বাহিনীর সামনে টার্গেট ১৪৯। শেষ ওভারটি বাদ দিলে সারাক্ষণই শফিউল, আল আমিন হোসেন, আমিনুল ইসলাম বিপ্লব ও আফিফ হোসেন ধ্রুবরাই কল কাঠি নেড়েছেন। ভারতীয় ইনিংসের ২০ নম্বর ওভারে আল আমিন ১৬ রান না দিলে হয়ত টার্গেট আরও ছোট হতো।

ভুলে গেলে চলবে না টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট শুধু খেলাই নয়। একটা পরিপূর্ণ প্যাকেজ। খেলা অবশ্যই। সাথে বিনোদন। চার ছক্কার ফুলঝুড়ি। বাহারি আর আক্রমণাত্মক উইলোবাজির অবাধ প্রদর্শনী দেখার সুযোগ। পাশাপাশি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিপণন। বাণিজ্যও। যে সময়ে একটি হিন্দি সিনেমা দেখা যায়, প্রায় একই সময়ের মধ্যে একটি ২০ ওভারের ফরম্যাটের ম্যাচ শেষ হয়ে যায়।

দর্শক, সমর্থক ও ভক্তরা বেশিরভাগ সময় ওই রানের নহর বইতে আর ছয়-চারের অবাধ প্রদর্শনী দেখে অভ্যস্ত হলেও সব সময় বা সবদিন কিন্তু ব্যাটসম্যানরাই এ ফরম্যাটে কর্তৃত্ব ফলান না। কখনো কখনো টি-টোয়েন্টি ম্যাচ যে বোলারদেরও হয়ে যায়। কোন কোন টি-টোয়েন্টি ম্যাচ এমন পিচে হয়, যেখানে ব্যাটসম্যানদের ইচ্ছেমত আক্রমণাত্মক শটস খেলা কঠিন।

আজ অরুন জেটলি (সাবেক ফিরোজ শাহ কোটলা) স্টেডিয়ামের যে পিচে খেলা হয়েছে, সেটাও ঠিক তেমনি। এটা ঠিক আদর্শ টি-টোয়েন্টি পিচ নয়। এখানে বল একটু থেমে আসে। স্পিনারদের বল একটু গ্রিপও করেছে। ইচ্ছেমত আক্রমণাত্মক শটস খেলা, স্বাভাবসূলভ পাওয়ার-পিঞ্চ হিটিং করা সহজ কাজ নয়। বল দেরিতে আসে। একটু আধটু ম্যুভমেন্ট-সুইংও করছে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দেখে না খেললে শটের ওপর নিয়ন্ত্রন রাখা কঠিন।

যারা প্রায় সারা বছর ২০ ওভারের ম্যাচে মাঠে আলো ছড়ান, আইপিএলে যাদের ফ্রি স্টোক প্লে দেখে সমর্থক-ভক্তরা হন মুগ্ধ। পুলকিত। সেই রোহিত শর্মা, শিখর ধাওয়ান, লোকেশ রাহুলদের আজ দিল্লির মাঠে সাকিব বিহীন বাংলাদেশের কমজোরি বোলিংয়ের বিপক্ষে কি কষ্টটাই না করতে হলো!

তরুন স্পিনার লেগি আমিনুল ইসলাম বিপ্লব আর অফব্রেক আফিফ হোসেন ধ্রুবর বল খেলতে কষ্ট হয়েছে। শেষ ওভারটি ছাড়া পেসার শফিউল আর আল আমিনও সমীহ আদায় করে নিয়েছেন।

এটা ব্যাটিং স্বর্গ নয়। টিপিক্যাল ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি পিচও নয়। এখানে বোলাররা ভাল জায়গায় বল ফেলতে পারলে ব্যাটসম্যানের বিগ হিট নেয়াটা সহজ নয়। তা প্রথম সেশনেই সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে।

যেখানে রোহিত শর্মা-শিখর ধাওয়ান, লোকেশ রাহুলদের মত আক্রমণাত্মক উইলোবাজরাও বাংলাদেশের বোলারদের ওপর এতটুকু ছড়ি ঘোরাতে পারেননি।

লাইন-লেন্থ ভাল ছিল সবার। কেউ বাড়তি কিছু করার চেষ্টা করেনি। জেনে ও বুঝে গিয়েছিলেন, উইকেট বোলারদের পক্ষে। এখানে জায়গামত বল করতে পারলেই চলবে। উইকেটের স্লথ গতি আর একটু আধটু ম্যুভমেন্ট কাজে লাগানোয় প্রথম ওভারেই দেখা মিললো সাফল্যের।

শফিউলের ইন কাটারে রোহিত শর্মার বিদায় বোলারদের করেছে উজ্জীবিত। আর তারপর লেগস্পিনার আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের বলের গতি ও টার্নের সাথে তাল মেলাতে না পেরে আউট লোকেশ রাহুল আর শ্রেয়াস আয়ার। এরপর আফিফের স্পিন বলে অসাধারণ ক্ষিপ্রতা ও চপলতায় ধরা ক্যাচের শিকার হয়ে সাজ ঘরে।

এরপর শফিউলের বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে নাইম শেখের হাতে সীমানার কাছে আউট হলেন রিশাভ পান্ত। আর তাতেই মনে হলো ১৩৫-১৪০ এ আটকে যাবে ভারত; কিন্তু শেষ ওভারে ওয়াশিংটন সুন্দর ৫ বলে দুই ছক্কা হাঁকালে ভারতের স্কোর ১৪৮-এ পৌঁছে যায় রোহিত শর্মার দল।

শুধু বুক চিতিয়ে লড়াই আর চার ও ছক্কা হাঁকালেই চলবে না, ১৪৯ রান টপকে যেতে দরকার বড় শটে না গিয়ে বলের মেধা ও গুণ বিচার করে খেলা। আর সেই সাথে আলগা বলে বিগ হিট নেয়া।

সৌম্য সরকার, নাইম শেখ আর মুশফিকুর রহীমরা ঠিক সেই কাজটিই করছিলেন। দেখে মনে হচ্ছিলো, আজ ঠিকই হয়ে যাবে। কারণ ব্যাটিংয়ের কোন সময় উইকেট আর রানের চাপে পড়েনি রিয়াদের দল। সব সময় রানের চাকা মোটামুটি সচল ছিল।

উইকেটও পড়েনি তেমন। লিটন দাস (৭) শুরুতে আউট হলেও নাইম শেখ আর সৌম্য সরকার দ্বিতীয় উইকেটে ৪৬ এবং সৌম্য আর মুশফিক তৃতীয় উইকেটে ৬০ রানের জুটি দুটি দলকে জয়ের খুব কাছে নিয়ে যায়।

নাইম শেখ কটি সাহসী শটস খেলে ২৮ বলে ২৬ রানে ফেরেন লেগ স্পিনার চাহালের বলে বিগ হিট নিতে গিয়ে। আর সৌম্য সরকারও (৩৫ বলে ৩৯) মোটামুটি আস্থায় খেলে পরিস্থিতি সামলাতে রেখেছেন কার্যকর অবদান। তবে অনেকদুর এগিয়ে শেষ রক্ষা করতে পারেননি সৌম্য। পেসার খলিল আহমেদের বলে বোল্ড হয়ে ফেরেন।

তারপর সব দায়-দায়িত্ব বর্তায় সেই দুই ভায়রা ভাই মুশফিকুর রহীম আর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের কাঁধে। ওয়েল সেট মুশফিক আর ১৭ নম্বর ওভারে উইকেটে যাওয়া অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ যখন উইকেটে যান, তখন শেষ ১৮ বলে দরকার ছিল ৩৫ রানের।

১৯ নম্বর ওভারে পেসার খলিল আহমেদকে চার বাউন্ডারি হাাঁকানোসহ ১৮ রান তুলে জয়ের খুব কছে চলে যান মুশফিক। শেষ ৬ বলে ৪ রানের দরকার থাকা অবস্থায় স্লো মিডিয়াম শিভাম দুবের করা খেলার শেষ ওভারে ৩ বল হাতে রেখেই লক্ষ্যে পৌঁছে যায় টাইগাররা।

তিন বছর আগে যিনি জয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ভারতীয় পেসার হার্দিক পান্ডিয়াকে পুল করতে গিয়ে আউট হয়ে খলনায়ক বনে গিয়েছিলেন, আজ তিন বছর পর সেই মুশফিক এবার নায়ক। সৌম্য সরকারের সাথে দলকে জয়ের পথে এগিয়ে দেয়া মুশফিক একদম শেষ দিকে গিয়ে জ্বলে ওঠেন।

তিন বছর আগেও তিনি পরপর দুই বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়ে শেষ তিন বলে ২ রান দরকার থাকা অবস্থায় তুলে মারতে গিয়ে আউট হয়ে খলনায়ক বনে গিয়েছিলেন। আজ আর মুশফিক কোনো ভুল করেননি। কিছু সাহসী শটস খেলেছেন।

প্রিয় শট রিভার্স সুইপ আর স্কুপে বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন বেশ কটি। ১৯ নম্বর ওভারে ভারতীয় পেসার খলিল আহমেদকে ইচ্ছেমত পিটিয়ে মুশফিক পূর্ণ করেন হাফ সেঞ্চুরি। মিডিয়াম পেসার শিভাম দুবের বলে তার ৪৩ বলে ৬০ রানের হার না মানা ইনিংসটিই বাংলাদেশকে এনে দেয় ঐতিহাসিক জয়ের স্বাদ।

ভারতের সাথে তিন বছর আগে ব্যাঙ্গালোরে বিশ্ব টি টোয়েন্টি ম্যাচে মুশফিকুর রহিমের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যিনি ভিলেন বনে গিয়েছিলেন, সেই মাহমুদউল্লাহও আজ আর কোনো ভুল করেননি। শিভাম দুবের বলে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা হাঁকিয়ে বাংলাদেশকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন আজকের অধিনায়ংক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।