ঘুরেফিরে বারবার আলোচনায় আসছেন নারায়ণগঞ্জ থেকে সদ্য প্রত্যাহার পুলিশ সুপার (এসপি) হারুন অর রশিদ। গত বছর নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের পর ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে কয়েক মাস ধরে বারবার আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনি। সবশেষ আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলের স্ত্রী ও ছেলেকে আটকের ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে এখন হারুন অর রশীদ। এ ঘটনায় রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে প্রত্যাহার করে সদর দপ্তরে ট্রেনিং রিজার্ভ (টিআর) পদে বদলি করে।

গত শনিবার নারায়ণগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে হারুন অর রশিদ দাবি করেন, শুক্রবার রাত ৩টায় সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় শওকত আজিজ রাসেলের বিলাসবহুল গাড়ি থেকে ১২শ পিস ইয়াবা, ২৮ রাউন্ড গুলি ও বিপুল পরিমাণ মদ উদ্ধার

করা হয়। এ সময় গাড়িচালক সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এসপি হারুন বলেন, গাড়িতে রাসেলের স্ত্রী ফারাহ রাসেল ও তাদের ছেলে আনাব আজিজও ছিলেন। রাতে তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়। পরে রাসেলের বাবা পারটেক্সের চেয়ারম্যান এমএ হাসেমসহ পরিবারের সদস্যরা ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে রাসেলের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশকে সহায়তার মুচলেকা দিয়ে ফারাহ রাসেল ও আনাব আজিজকে ছাড়িয়ে নেন।

তবে শওকত আজিজ রাসেলের দাবি, সম্প্রতি আম্বার গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান আম্বার ডেনিমের কাছে ৮ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন এসপি হারুন। চাঁদা না দেওয়ায় সাদা পোশাকধারী ও পুলিশের পোশাক পরিহিত ৬০-৭০ জন শুক্রবার গভীর রাতে তার গুলশানের বাসায় গিয়ে তাকে খোঁজাখুঁজি করে। তাকে না পেয়ে তুলে নিয়ে যায় তার স্ত্রী ও ছেলেকে। এর পর তাদের নারায়গঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা ক্লাব থেকে তার গাড়িটিও আটক করে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ। সিদ্ধিরগঞ্জে স্ত্রী-ছেলেকে আটক বা গাড়ি, মাদক-গুলি উদ্ধারের ঘটনাগুলো সাজানো বলে দাবি করেন রাসেল।

স্ত্রী-সন্তানকে গ্রেপ্তারের পর রাসেলের গুলশানের বাড়ির সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে ফারাহ রাসেল ও আনাব আজিজকে তুলে নেওয়ার দৃশ্য দেখা গেছে।

এ নিয়ে শওকত আজিজ রাসেল বলেন, এসপি বলেছেন ইয়াবা, গুলি ও মদসহ সিদ্ধিরগঞ্জে দুজনকে আটক করা হল। কিন্তু ফুটেজে সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। এতে স্পষ্ট, ইয়াবা, গুলি ও মদের বোতল উদ্ধারও বানোয়াট।

এ প্রসঙ্গে হারুন অর রশিদ গতকাল সোমবার আমাদের সময়কে বলেন, চাঁদাবাজির অভিযোগ ভিত্তিহীন। মামলার দুদিন পর শওকত আজিজ রাসেলের গুলশানের বাসায় তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হয়। এ সময় তার বিষয়ে খবর জানতে ছেলে আনাবকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়। শওকত আজিজ রাসেলের স্ত্রী তখন পুলিশকে বলছিলেন, আমার ছেলে ভয় পাবে। আমিও সঙ্গে যাব। হারুন বলেন, আমরা তো শওকত আজিজ রাসেলের স্ত্রীকে আটক করিনি। তিনি নিজেই চলে এসেছেন। সেখানে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থাকতেই পারে।

এর আগে ২০১৬ সালের ৫ মে এসপি হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে প্রতিকার চেয়ে রাষ্ট্রপতি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন, র‌্যাব মহাপরিচালক, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দেন শওকত আজিজ রাসেল।

অভিযোগে বলা হয়, তৎকালীন গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ আম্বার ডেনিমের স্টোর ম্যানেজার ইয়াহিয়া বাবুর মোবাইলে ফোন দিয়ে ৫ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। এসপি হারুন ফোনে বলেন, রাসেলের লোকজনকে ডাকাও। আমার টাকা লাগবে, তাড়াতাড়ি ৫ কোটি টাকা পাঠাও। এর আগেও এসপি হারুন গুলশান ক্লাবের লামডা হল ও গুলশান কাবাব ফ্যাক্টরি রেস্তোরাঁয় ডেকে ৫ কোটি টাকা দাবি করেন। ওই টাকা যুক্তরাষ্ট্রে হারুনের নির্ধারিত ঠিকানায় না পাঠালে তার ডেনিম প্রতিষ্ঠান ধ্বংসের হুমকি দেওয়া হয়। টাকা না দেওয়ায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আম্বার ডেনিম ফ্যাক্টরির ৪৫ কর্মকর্তা-কর্মচারী-শ্রমিককে গভীর রাতে ধরে নিয়ে এসপি হারুন মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখান বলেও অভিযোগ করেন রাসেল। ওই ঘটনায় ঢাকা রেঞ্জের তৎকালীন ডিআইজি বরাবর এসপি হারুনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। তৎকালীন ডিআইজি দুপক্ষকে ডাকলেও প্রতিকার মেলেনি।

শওকত আজিজ রাসেল বলেন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও সিদ্ধিরগঞ্জে তার গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেখানেও মাসে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন এসপি হারুন। ওই চাঁদা না দেওয়ায় মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা করেন।

গত বছরের শেষ দিকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে পদায়ন করা হয় হারুন অর রশীদকে। সেখানে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পরই শামীম ওসমানের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তার। এ নিয়ে বারবার গণমাধ্যমের খবর হয়ে আলোচনায় ছিলেন এসপি হারুন।

ঢাকা মহানগরের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সালে গাজীপুর জেলার পুলিশ সুপার হন হারুন অর রশিদ। গাজীপুরে ‘মুক্ত সংবাদ’ নামে স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক সোহরাব হোসেনকে চাঁদাবাজির মামলায় জড়িয়ে গ্রেপ্তারের অভিযোগ ওঠে হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে।

সোহরাব হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, জেলার সাব-রেজিস্ট্রার মনিরুল এসপি হারুনের বন্ধু। ঘুষের বিনিময়ে মনিরুল জমির মূল্য কম দেখিয়ে দলিল করানÑ এ নিয়ে নিউজ করি। এতে এসপি হারুন ক্ষুব্ধ হয়ে তার বন্ধুকে আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করেন।

২০১১ সালের ৬ জুলাই বিএনপির ডাকা হরতালে রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় হুইপ জয়নুল আবেদীন ফারুককে প্রকাশ্যে পিটিয়ে আলোচনায় আসেন হারুন অর রশিদ। ওই সময় হারুন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের এডিসি ছিলেন।