উচ্চবর্ণের দরিদ্রদের জন্য ১০ শতাংশ কোটা চালু করে একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাস করার মধ্য দিয়ে যখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০১৯ সাল শুরু করেছিল, তখন এটা আমাদের বোঝা উচিত ছিল যে এই বছরটা হবে এমন একটি বছর, যেখানে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। মোদি সরকার যা করবে, তা হিন্দুদের জন্যই করবে, মূলত এ ধারণার কারণেই গত মে মাসের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি ফের দেশ পরিচালনার বিশাল ম্যান্ডেট পেয়েছেন।
এই সপ্তাহান্তে, সুপ্রিম কোর্টের একটি যুগান্তকারী রায়ের পর স্পষ্ট হয়ে উঠল যে অযোধ্যা এমন একটি জায়গায় একটি রামমন্দির পেতে চলেছে, যেখানে ১৯৯২ সালে সংঘটিত হিন্দুত্ববাদী জনতা ১৬ শতকে নির্মিত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে, যা দেশজুড়ে দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটায়।
আপনি যদি এ মামলার ইতিহাসের সঙ্গে অপরিচিত থাকেন, তবে এখানে একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হলো: অযোধ্যার যে জমির ওপর বাবরি মসজিদের অবস্থান ছিল, সেই জমিকে কেন্দ্র করে এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ হয়েছে। হিন্দুদের দাবি, এ স্থান ভগবান বিষ্ণুর অন্যতম অবতার রামের জন্মভূমি। ১৯৪৯ সালে, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো বাবরি মসজিদে একটি রামমূর্তি স্থাপনের ষড়যন্ত্র করেছিল, যার ফলে মসজিদটি কার্যকরভাবে একটি অস্থায়ী হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। এ ঘটনা ওই জমির মালিককে আদালতে মামলা দায়ের করতে বাধ্য করেছিল।
তারপর ১৯৮০-এর দশকে বিজেপি এবং তার মূল সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ স্পষ্টতই অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের জন্য দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করে, উত্তেজনা ছড়িয়ে দেয় হিন্দুদের মধ্যে। আর এই উত্তেজনার অবসান ঘটে ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে বাবরি মসজিদ ভাঙার মধ্য দিয়ে। তখন থেকেই মামলাটি আদালতে ছিল, যদিও ইস্যুটি খুবই স্পর্শকাতর এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ ছিল, তারপরও বিজেপি এই স্থানে রামমন্দির নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
গত শনিবার, সুপ্রিম কোর্ট ৪০ দিনের তর্কবিতর্কের পর অবশেষে মামলার রায় ঘোষণা করলেন। রায়ের সংক্ষিপ্ত রূপটি হচ্ছে: যে জমি নিয়ে বিতর্ক চলে আসছিল, তা হিন্দুদের হাতে দেওয়া হয়েছে এবং সরকার এখন ট্রাস্ট স্থাপন করবে, যা মন্দির নির্মাণসহ সব কার্যক্রম তদারকি করবে। মসজিদ ভাঙার ক্ষতিপূরণ হিসেবে মুসলিম দলগুলো অন্য একটি জমি পাবে, যা আকারে হবে বিতর্কিত জমির চেয়ে দ্বিগুণ। তবে কোথাকার জমি মুসলমানদের দেওয়া হবে, তা বিজেপিশাসিত রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এ বছরের শুরুর দিকে ভারতে কিছু লোক ছিল, যারা বিশ্বাস করত যে তাদের জীবদ্দশায় কোনো রামমন্দির নির্মিত হবে না, এ রকমটা মনে করার পেছনে কারণ হচ্ছে মন্দিরের চেয়ে প্রতিশ্রুতিটাই রাজনৈতিকভাবে বেশি শক্তিশালী। এখন সেসব মানুষের আশা পূরণ হতে যাচ্ছে।
তখন থেকে বিষয়গুলো দ্রুতগতিতে চলেছে। নরেন্দ্র মোদি সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে একতরফাভাবে জম্মু ও কাশ্মীরকে রাজ্য থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে রূপান্তর করেছেন। এখন সুপ্রিম কোর্ট একটি রামমন্দির নির্মাণের পথ প্রশস্ত করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে: এরপর কী। ৩৭০ ধারা গেল, একটি রামমন্দির নির্মাণের পথে। এরপর মোদি সরকারের পরিকল্পনা কী।
কী ঘটতে পারে, তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়।
১. নিখিল ভারত জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বেশ কিছুদিন ধরে দেশের সব রাজ্যে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এর মধ্য দিয়ে সুস্পষ্টভাবেই মুসলমানরা রাষ্ট্র অনুমোদিত হয়রানির শিকার হবে।
২. অভিন্ন সিভিল কোড: হিন্দু ডানপন্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি হচ্ছে অভিন্ন সিভিল কোড চালু করা এবং স্বতন্ত্র ধর্মের ব্যক্তিগত আইন বাতিল করা। এর ফলে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠদের আইন অনুসরণ করতে বাধ্য থাকবে।
৩. ধর্ম পরিবর্তনবিরোধী আইন: কয়েকটি রাজ্যের বহু পুরোনো দাবি হচ্ছে ধর্ম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একটি আইন করা, যাতে কোনো হিন্দু ব্যক্তি অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে না পারে। কারণ, ভারতে প্রায়ই ঘুষ দিয়ে হিন্দুদের খ্রিষ্টধর্মে রূপান্তরের ঘটনা ঘটে থাকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিজেপি কখন এসব দাবি বাস্তবায়ন করবে? অর্থনীতির মন্দা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে সরিয়ে আনার জন্য কি এখনই এসব দাবি বাস্তবায়ন করবে? নাকি বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বা ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে, যাতে এসব দাবি বিক্রয় পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
গত ১০ মাসে হিন্দুত্ববাদী বাহিনী এত কাজ করেছে যে এরপর কী হবে, তা অনুমান করা শক্ত। তবে যা স্পষ্ট, তা হলো দেশজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও বিজেপির পতাকা উঁচুতে উড়ছে এবং তারা এটা বজায় রাখার জন্য যেকোনো কিছুই করতে পারে।
স্ক্রল ডট ইন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
রোহান ভেঙ্কটারামাকৃষ্ণান: স্ক্রল ডট ইনের সহযোগী সম্পাদক