► শেখ হাসিনা-কোঁতে বৈঠক, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদারে সম্মত
► রোহিঙ্গাদের জন্য আরো ১০ লাখ ইউরো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ইতালির

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এ পর্যন্ত যাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি এবং তাঁর বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই কেবল এ মাটির সন্তান। এ জন্যই তিনি ত্যাগ স্বীকার করেও জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়া এবং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ—তাঁদের একজনও এ মাটির সন্তান ছিলেন না।

ইতালি সফরের প্রথম দিন স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রোমের পার্কে দে প্রিন্সিপি গ্র্যান্ড হোটেল অ্যান্ড স্পাতে ইতালি আওয়ামী লীগ আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এসব মন্তব্য করেন। এদিকে গতকাল বুধবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরো জোরদার করতে সম্মত হয়েছেন ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতে। বৈঠকে ইতালি রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় আরো ১০ লাখ ইউরো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের জন্ম বিহারে, এরশাদের জন্ম কোচবিহারে, খালেদা জিয়ার জন্ম শিলিগুড়ি। একজনও এই মাটির সন্তান না।’ তাঁদের কারো জন্ম বাংলাদেশে নয় বলে তাঁরা দেশের উন্নয়নের ব্যাপারে আন্তরিক ছিলেন না বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ‘এই মাটির সন্তান এখন পর্যন্ত যতজন ক্ষমতায় এসেছে, একমাত্র আমার বাবা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং আমি শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মাটির সন্তান। যেহেতু আমাদের মাটির টান আছে, এই জন্য আমাদের একটা কর্তব্যবোধ আছে।’

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকের বুলেটে মা-বাবাসহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে হারানোর কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, ‘জীবনের সব কিছু ত্যাগ করে একটা কাজই করে যাচ্ছি, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যটা পরিবর্তন করতেই হবে। সেই কথা চিন্তা করে আমরা প্রত্যেকটা পদক্ষেপ নিচ্ছি।’

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ যেকোনো দেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে। আওয়ামী লীগ শুধু দেশের উন্নয়ন চায়। আমাদের আর কেউ পেছনে টানতে পারবে না। আমরা সামনে এগিয়ে যাব। এটাই হলো সব থেকে বড় কথা।’

বাংলাদেশের সব উন্নয়ন প্রকল্পের ৯০ শতাংশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখন আমরা উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বাংলাদেশকে ভিক্ষা দেওয়ার কথা বলি না। বরং তারা আমাদেরকে তাদের উন্নয়ন সহযোগী অভিহিত করে সহযোগিতা দিতে আসে। কারণ কারো কাছে আমরা ভিক্ষা চাই না।’

এ সময় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশি প্রবাসীদের সংশ্লিষ্ট দেশের নিয়ম-নীতি মেনে চলার আহ্বান জানান, যাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। তিনি বলেন, সরকার দেশের প্রতিটি উপজেলা থেকে কমপক্ষে এক হাজার জনকে বিদেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

বিমানবন্দরে অনেক সময় প্রবাসীদের হয়রানির শিকার হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘আসলে আমাদের দেশের কিছু মানুষের চরিত্রই খারাপ। যেই শুনে বাইরে থেকে আসবে, ভাবে যে একটু চাপ দিলেই মনে হয় কয়েকটা ডলার পাওয়া যাবে। একটা কথা মনে রাখবেন—ঘুষ যে দেয় সেও যেমন অপরাধী, যে নেয় সেও অপরাধী। এই দিয়ে দিয়ে অভ্যাসটা আপনারা খারাপ করেন। আগামীতে আর করবেন না।’

দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক : ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতের সঙ্গে রাজধানী রোমে তাঁর বাসভবন পালাজ্জো চিগিতে গতকাল বৈঠক করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, প্রায় এক ঘণ্টার এ বৈঠকে দুই প্রধানমন্ত্রী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সার্বিক দিক নিয়ে আলোচনা করেন এবং দুই দেশের মধ্যকার বর্তমান আর্থ-সামাজিক অবস্থানে উভয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। ইতালির প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলোচনাকে ‘ফলপ্রসূ’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।

রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনাকালে জিউসেপ কোঁতে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেন। প্রেসসচিব তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, “১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার আপনার ‘সুপার হিউম্যান’ উদ্যোগ প্রশংসনীয়।” এ প্রসঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর দেশ রোহিঙ্গাদের জন্য বর্তমান সহায়তার অতিরিক্ত আরো ১০ লাখ ইউরো দেবে। এ সহায়তা ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে দেওয়া হবে।

প্রেসসচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নির্দেশনা মেনে চলতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে ইতালিসহ আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। ইতালিকে বাংলাদেশের মহান বন্ধু উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর তাত্ক্ষণিকভাবে যে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তার মধ্যে ইতালি অন্যতম। তাঁর এ সফরের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

প্রেসসচিব জানান, আলোচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সহযোগিতার ব্যাপারে কিছু পরামর্শ দিয়ে বলেন, দুই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এসব খাত সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। জবাবে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর দেশ গুরুত্বের সঙ্গে এসব পরামর্শ বিবেচনা করবে। জিউসেপ কোঁতে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যুৎ ও প্রতিরক্ষা খাতে সহযোগিতা জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ইতালি অনেক পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানির প্রস্তাব দিতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ব্যাপক আকারে বিনিয়োগের জন্য ইতালির উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ইতালি বাংলাদেশ থেকে আরো বেশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য আমদানি করতে পারে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের পর ইতালিতেই সর্বোচ্চসংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছে। তারা উভয় দেশের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখছে। এসব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধে অঙ্গীকারবদ্ধ।

জিউসেপ কোঁতে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধির উল্লেখযোগ্য সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি ইতালিতে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রশংসা করে বলেন, তারা কঠোর পরিশ্রমী।

শেখ হাসিনা মুজিববর্ষের কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য ইতালির প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানান। এর আগে শেখ হাসিনা পালাজ্জো চিগিতে পৌঁছলে প্রাসাদের রক্ষীরা তাঁকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। এ সময় দুই দেশের জাতীয় সংগীত বাজানো হয়।

রোমে চ্যান্সেরি ভবন উদ্বোধন : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোমে বাংলাদেশ দূতাবাসের চ্যান্সেরি ভবন উদ্বোধন করেছেন। স্থানীয় সময় গতকাল বুধবার সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইতালির রাজধানীর ভিয়া ডেল অ্যান্ট্রাটাইড এলাকায় ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে ২৩ দশমিক ৯ কাঠা জমির ওপর নির্মিত পাঁচতলা ভবনটির উদ্বোধন করেন তিনি।

এ সময় দেশ ও জাতির অব্যাহত শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়ন কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল ফলক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী চ্যান্সেরি ভবনের বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে দেখেন। এ সময় তিনি দর্শনার্থী বইয়েও স্বাক্ষর করেন। সূত্র : বাসস ও ইউএনবি।