নওগাঁ প্রতিনিধি,

গ্রামের নাম মশিদপুর। নওগাঁ জেলার মান্দা ও নিয়ামতপুর উপজেলা এবং রাজশাহীর তানোর উপজেলার সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত একটি গ্রাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও নানা কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রবণতা এখানে অনেক বেশি। তবে এত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে বর্তমানে বিভিন্ন অবস্থানে রয়েছেন গ্রামটির একদল যুবক।

নতুন প্রজন্মের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তারা গড়ে তুলেছেন একটি অরাজনৈতিক সংগঠন ‘মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি’। এ সংগঠনের আয়োজনে সারা বছরই শিক্ষামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়ে থাকে। তার মধ্যে বইমেলা অন্যতম। গত ১০ বছর ধরে বইমেলার আয়োজন করা হয় গ্রামটিতে। শিক্ষার মান উন্নয়নে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বইমেলার আয়োজন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সচেতন ব্যক্তিরা।

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে ভাষা শহীদদের স্মরণে এ নিভৃত পল্লীতে এক অন্যরকম বইমেলার আয়োজন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এবার শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বইমেলা অনুষ্ঠিহ হয়েছে। রাজশাহী ও স্থানীয় বইয়ের দোকানিরা সেখানে বই নিয়ে আসেন। মেলায় দেশের বিভিন্ন গুণিজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তারা শিক্ষার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে এলাকাবাসীর মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করেন।

বইয়ের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে দিনব্যাপী বইমেলার আয়োজন করা হয়। যেখানে শিশু-কিশোর-কিশোরী ও আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা পড়াশোনা-বই কেনাকাটায় বছরের একটি দিন ব্যস্ত থাকেন। শুধু এ গ্রামের মানুষের জন্য বইমেলার আয়োজন নয়, আশপাশের তিন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ বইমেলাকে কেন্দ্র করে এক দিনের উৎসবে মেতে ওঠেন।

শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষে বই পড়া, বই কেনা ও শিক্ষার প্রতি নতুন প্রজন্মকে আগ্রহী করে গড়ে তোলার লক্ষে ২০১১ সাল থেকে ‘মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি’র উদ্যোগে বই মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এ সমিতির ব্যানারেই শিক্ষার প্রসারে নানা কার্যক্রম চলে বছরজুড়েই।

শুধু বইমেলা নয়, দিনটিতে ফ্রি স্বাস্থ্য সেবা ও ওষুধ বিতরণ করা হয়ে থাকে। এছাড়া কবিতা আবৃতি, কৌতুক, চিত্রাঙ্কন ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতাও চলে। পরে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।

বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক টিপু সুলতান বলেন, বইমেলা এক সময় ছিল নগরকেন্দ্রিক। পরবর্তীতে জেলা পর্যায়ে শুরু হয়। কিন্তু এতো নিভৃত পল্লীতে বইমেলা দেখে আমি অভিভূত ও বিস্মিত। এলাকা ও আশপাশের মানুষের উৎসাহ দেখে আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি। পাঠ্য বইয়ের পর যে নতুন এক জগৎ আছে নতুন প্রজন্মরা বইমেলা থেকে তা বুঝতে পারবে। এখানে বইমেলার আয়োজনটা সারা দেশের মধ্যে মডেল হতে পারে বলে আমার বিশ্বাস।

মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি সাধারণ সম্পাদক শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তিনি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। নতুন প্রজন্মের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে আমরা সংগঠনটির যাত্রা শুরু করি। এ সমিতির ব্যানারেই বছরজুড়েই চলে শিক্ষার নানা কর্মসূচি। এ লক্ষ্যে প্রথমে আমরা মা, বাবা ও শিক্ষার্থী সমাবেশ এবং বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টি করতে বইমেলার আয়োজন করি। গত ১০ বছর থেকে বইমেলার আয়োজন করা হচ্ছে। যেখানে প্রতিবছর দেশের শিক্ষাবিদদের ওই গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তারা শিক্ষার উন্নয়নে দিকনির্দেশনা দেন।

অভ্যাস গড়ে উঠেছে। এ কারণে গ্রামে পর্যায়ক্রমে এখন শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভিভাবকরাও তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে আগ্রহী হচ্ছেন। আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- মানুষের মনোজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করা ও উৎসাহ জন্মানো। সেই সঙ্গে সবাইকে শিক্ষিত করে সমাজ ও আলোকিত বাংলাদেশ গড়া।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক এবং অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি নাজিব ওয়াদুদ বলেন, একটা গ্রামের বইমেলার কথা বাংলাদেশে কল্পনা করা যায় না। তবে গত ১০ বছর থেকে ‘মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি’ যে কাজগুলো করছে এবং দেশের অধিকাংশ গ্রামে যদি এমন উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে গ্রামগুলোর শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চিত্র পাল্টে যাবে বলে মনে করছি।